বিদ্যুৎ না থাকা ও লোডশেডিং নিয়ে উত্তপ্ত সংসদ। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা এ জন্য মন্ত্রণালয়কে দায়ী করেছেন। তারা বলেছেন, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় নেই, যার ফলে আজ এ অবস্থা। কোনো সময় বিদ্যুৎ থাকবে না, কোনো সময় থাকবে- কেউ কিছুই জানে না। একেবারে নো ম্যানস ল্যান্ডের মতো অবস্থা তো চলে না। কেন বিদ্যুৎ নেই, কখন থাকবে না তা জনগণকে জানান। এ সময় সংসদ নেতাকে ‘ঘসেটি বেগম’ থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা। গতকাল একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সম্পূরক বাজেট পাসের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নেন কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমাম, রুস্তম আলী ফরাজী, রওশন আরা মান্নান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান প্রমুখ। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদে সভাপতিত্ব করছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনা নিয়ে সংসদে তীব্র সমালোচনা হলেও ‘বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ খাতে ৩২ কোটি ৪৬ লাখ ৪ হাজার টাকা সম্পূরক বাজেট’ পাস করা হয়। কণ্ঠভোটে তা পাস হয়।
সম্পূরক বাজেটের ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি’। তিনি বলেন, অসময়ে আমরা ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ফেলেছি, অথচ আমাদের লাগে ১৪ হাজার মেগাওয়াট, বাকিটা নষ্ট হয়েছে। আজকে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৭ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি ৩২ কোটি ৪৬ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত চেয়েছেন। আর আপনার বাকি আছে বিভিন্ন কলকারখানার কাছে ২ হাজার কোটি টাকা। আপনাকে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির অনেক বিল পরিশোধ করতে হবে, যা ৭১ বিলিয়র ডলার। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসবে তা ফখরুল ইমাম জানতে চান।
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিদ্যুৎ না থাকলে শিল্পায়ন কমে যাবে, কৃষি উৎপাদনে ধস নামবে। একসময় বিদ্যুৎ ছিল। দেশের প্রতিটা গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুৎ ছিল। কিন্তু এই গরমে হঠাৎ করে কেন বিদ্যুৎ চলে গেল। এর জন্য আগে থেকেই কয়লা, ডিজেল আমদানি করা উচিত ছিল। আমি মনে করি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় নেই, যার ফলে আজ এই অব্যবস্থা। এই প্রচ- গরমে আমরা মনে করি অতি দ্রুত আমাদের কয়লা আমদানি করতে হতে হবে, যাতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত চালু করা যায়। তিনি বলেন, সচিবালয়ে দেখা গেছে সচিবদের বাথরুমের মধ্যেও এসি আছে, সেখানে সেন্ট্রাল এসি চালিয়ে রেখেছে, তাদের এসি আবার হাই ভোল্টেজে, তা একবার চললে আর বন্ধ হয় না। অথচ গ্রামের মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। শহরের কিছু ধনিক শ্রেণির মানুষের জন্য কেন গ্রামের মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে পারবেন না তা হতে দেওয়া যায় না। তিনি আওয়ামী লীগের এমপি হাবিবুর রহমানের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন, বিদ্যুৎ তো মানুষ পাচ্ছেই না। এর মধ্যে তিনি কী করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তোলেন! রুস্তম আলী ফরাজী প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনি কেন বলেন না কোন সময় বিদ্যুৎ থাকবে না, কোন সময় থাকবে। মন্ত্রণালয়ের চরম সমন্বয়হীনতা রয়েছে। কেউ কিছুই জানে না। একেবারে নো ম্যানস ল্যান্ডের মতো অবস্থা তো চলে না। কেন বিদ্যুৎ নেই, কখন থাকবে না তা জনগণকে জানান। সংসদ নেতা শেখ হাসিনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘এখানে কিন্তু অনেক ঘসেটি বেগম থাকতে পারে। তারা কিন্তু আপনাদের সুনাম নষ্ট করতে পারে। এটা থেকে সাবধান।’
রওশন আরা মান্নান বলেন, ডলারের সংকটে এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, তেল আনা যাচ্ছে না। অথচ সোমবার এই সংসদে সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ভোলায় নাকি গ্যাসকূপের ছড়াছড়ি, একেবারে হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থা, সারা পৃথিবীর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। তাহলে সরকার কেন গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে না, তাহলে তো এ সংকট অনেকখানি কেটে যেত। এত সংকট দেখা দিত না। এখন যেভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে, এর ওপর আগামী ১০ বছরে গ্যাস একদম ফুরিয়ে যাবে, নতুন করে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তিনি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে গ্যাসকূপ কেন অনুসন্ধান করছে না, আবার বিদ্যুতের ভুয়া বিল কেন আসে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
শামীম হাওদার পাটোয়ারী বলেন, বিএনপি আমলে খাম্বা ছিল, বিদ্যুৎ ছিল না। আওয়ামী লীগ এসে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছে। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ থাকে না। যেভাবে রাতে-দিনে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা শুরু করছে, তাতে জনরোষের সৃষ্টি হবে।
এ মাসেই বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক হবে- নসরুল হামিদ : প্রতিউত্তরে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বেশি দিন আগের কথা না, মাত্র ১৪ বছর আগেও প্রায় ৬০ শতাংশ বাংলাদেশ অন্ধকারে ছিল। কভিড আমাদের স্মরণ শক্তির ক্ষতি করেছে। কারণ আমরা খুব দ্রুত ভুলে যাই। আগে ১৭-১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। সেখানে আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছি। আমরা সঞ্চালন লাইন করেছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। যখন আমরা ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলি, তখন প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার খরচের বিষয় ছিল। এর ওপর সঞ্চালন লাইন, ডিস্ট্রিবিউশন লাইন ও জ্বালানি খরচও কিন্তু দিতে হয়। আমাদের প্রস্তুতি আছে ২০-২২ হাজার মেগাওয়াটের। যে কোনো মুহূর্তে উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু কভিড-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো চ্যালেঞ্জ এসেছে, সারা বিশ্বে জ্বালানিসহ সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। পাওয়া যাচ্ছে না গ্যাস ও তেল, দামও অস্বাভাবিক। আরও বড় চ্যালেঞ্জ আছে- বিশ্বের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে শুধু তা নয়, এর ওপর পাব কী পাব না তাও অনিশ্চিত। তিনি বলেন, বর্তমানে দিনের বেলায় ১২ হাজার থেকে সাড়ে বারো হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করছি, রাতের বেলায় ১৫ হাজার। আমাদের ঘাটতি রয়েছে ২ থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট। তিনি বলেন, প্রতিবছর জ্বালানি বাবদ ৮ হাজার কোটি টাকা, গ্যাসে ১২ হাজার কোটি, আর এ বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈশি^ক অবস্থার কারণে আমরা সময়মতো কয়লা আনতে পারিনি। তবে ১৫-১৬ দিনের মধ্যে কয়লা এসে যাবে। আবার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে। তিনি বলেন, প্রায় ৪০ লাখ অটোরিকশা মধ্যরাতে চার্জ দিতে ৩৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খেয়ে নিচ্ছে। আমরা তো বন্ধ না করে ইনক্রিজ করছি। আশা করছি এ মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সমস্যা কেটে যাবে।