শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ গোলাগুলি

আরসা কমান্ডারসহ নিহত ৬ ♦ নিরাপত্তা বাড়িয়েছে পুলিশ ♦ এলাকা থমথমে

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ গোলাগুলি

কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গতকাল দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলির পর নিরাপত্তা জোরদার করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। রোহিঙ্গাদেরই বিভিন্ন গ্রুপ মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। গতকাল ভোরেও উখিয়ার একটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুটি গ্রুপের গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। ক্যাম্প-৮ পশ্চিমের এ ঘটনায় নিহতের প্রত্যেকেই মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ। ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা নিহত চারজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। তাদের একজন আরসা কমান্ডার, একজন জিম্মাদার ও বাকিরা সাধারণ সদস্য। পরে বিকাল ৫টার দিকে একই ক্যাম্প থেকে সানাউল্লাহ (৪৫) নামে আরও এক রোহিঙ্গার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় এসব সংগঠনের ২ হাজারের বেশি সদস্য এ অপতৎপরতায় জড়িত। উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক অস্থিরতার মিশনে অপতৎপরতা        অব্যাহত রেখেছে ৩০টির বেশি সশস্ত্র গোষ্ঠী। শুধু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুক্রবার (৭ জুলাই) পর্যন্ত ক্যাম্পে খুনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯-এ। এ নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৮২ জন খুন হয়েছেন। জানা গেছে, গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয় শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) বি-১৫, বি-১৬ ও বি-১৭ ব্লক এলাকায় আরসার সঙ্গে মিয়ানমারের আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। টানা এক ঘণ্টার মতো গোলাগুলি চলতে থাকে দুই গ্রুপে। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ৮ এপিবিএন সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরে ঘটনাস্থল থেকে তিনজন মৃত এবং গুলিবিদ্ধ গুরুতর দুজনকে উদ্ধার করে আইওএম হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তারা মারা যান। নিহতরা হলেন বালুখালী (ক্যাম্প-৮ ডব্লিউ) এইচ-৪৯ ব্লকের বাসিন্দা আনোয়ার ছাদেক (২২), একই ক্যাম্পের এ-২১ ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ হামিম (২১), বালুখালী (ক্যাম্প-১০) এইচ-৪২ ব্লকের বাসিন্দা মো. নজিবুল্লাহ (৩২), মধুরছড়া ক্যাম্পের (ক্যাম্প-৩) বি-১৭ ব্লকের বাসিন্দা নুরুল আমিন (২২) ও অজ্ঞাতনামা ২৫ বছর বয়সী আরেকজন রোহিঙ্গা। নিহত পাঁচজনই আরসার সদস্য দাবি করে ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন ও মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, গোলাগুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত তিনজনের একজন আনোয়ার ছাদেক ছিলেন বালুখালী আশ্রয় শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) এইচ-৪৯ ব্লকের প্রধান জিম্মাদার। নিহত নজিবুল্লাহ ছিলেন বালুখালী আশ্রয় শিবিরের (ক্যাম্প-১০) আরসার ক্যাম্প কমান্ডার। নিহত নুরুল আমিন ছিলেন মধুরছড়া আশ্রয় শিবিরের (ক্যাম্প-৩) বি-১৭ ব্লকের আরসার সক্রিয় সদস্য। নিহত অন্য দুজন আরসার সদস্য বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান চলছে।

আরসার সঙ্গে আরএসওর বিরোধ দীর্ঘদিনের উল্লেখ করে ফারুক আহমেদ বলেন, আশ্রয় শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার এবং পূর্বশত্রুতার জেরে দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ ঘটেছে। ঘটনাস্থল থেকে এপিবিএন একটি ওয়ান শুটারগান ও একটি গুলি উদ্ধার করেছে। পাঁচ হত্যাকান্ডের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্প এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয় শিবিরে অভিযান চালানো হচ্ছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, গতকাল ভোরে যে ক্যাম্পটিতে আরসা ও আরএসওর গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন, সেই ক্যাম্প থেকে বিকাল ৫টা নাগাদ গলাকাটা এক রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত রোহিঙ্গা সানাউল্লাহ (৪৫) ১১ নম্বর ক্যাম্পের ডি ব্লকের বাসিন্দা। সানাউল্লাহকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে গলা কেটে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র রয়েছে। তাদের পক্ষে আবার ছোট ছোট গ্রুপ কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।

জানা গেছে, উখিয়ার বালুখালী এলাকায় (ক্যাম্প-৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২) অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গার বসতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা বলছিলেন, বালুখালী আশ্রয় শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী বাহিনীর প্রধান নবী হোসেন। আরসাকে ঠেকাতে বছরখানেক আগে নবী হোসেনের সঙ্গে হাত মেলায় আরএসও। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে নবী হোসেন বাহিনী ও আরএসও সমর্থক রোহিঙ্গা মাঝিদের অপহরণের পর হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে আরসা। প্রতিশোধ নিতে আরসা যে কোনো সময় হামলা চালাতে পারে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয় শিবিরের সবকটিতে আরসার শক্ত অবস্থান রয়েছে। রয়েছে ভারী অস্ত্রশস্ত্রও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ভোর ৫টার দিকে আরসার ২০-২২ জন সন্ত্রাসী বালুখালীর (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) এইচ ব্লকের রোহিঙ্গা বসতিতে ঢুকে কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝিকে (নেতা) খুঁজতে থাকে। এ সময় রোহিঙ্গাদের মধ্যে হইচই শুরু হয়। খবর পেয়ে আরএসওর ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে পৌঁছে আরসা সদস্যদের ঘিরে ফেললে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ ঘটে, যা ক্যাম্পের বি-১৫, বি-১৬ ও বি-১৭ ব্লক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাসূত্র বলছেন, গুলিতে নিহত আনোয়ার ছাদেক বালুখালী ক্যাম্প-৮ (পশ্চিম) এইচ-৪৯ ব্লকের প্রধান জিম্মাদার ছিলেন। ইয়াবা বিক্রির টাকা, চাঁদাবাজির টাকা, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ লুণ্ঠিত মালামাল রক্ষিত থাকত তার কাছে। তার নির্দেশে রোহিঙ্গা মাঝিদের অপহরণের পর টাকা আদায়, হত্যা ও হত্যার পরিকল্পনা হয়। দুই বছর আগে ক্যাম্প-৮ থেকে নবী হোসেন বাহিনীর হাতে বিতাড়িত হয়ে নিহত নজিবুল্লাহ আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের বালুখালীর ক্যাম্প-১০-এ। কয়েক মাস আগে নজিবুল্লাহকে আরসার ক্যাম্প-১০-এর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার অত্যাচার-নির্যাতনে ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ ছিলেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের প্রধান লক্ষ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করা এবং বিভাজন বাড়ানো। এ ছাড়া প্রত্যাবাসনের পক্ষে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে খুন করা। যেমনটি হয়েছিল ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর। ওই দিন হত্যা করা হয় রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুহিবুল্লাহকে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা অধিকারের পক্ষে কথা বলে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলার অভিযোগপত্রে (চার্জশিটে) বলা হয়েছে। যার নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী বলা হয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনিকে। জেলা পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ছয় মাসে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ১৬ জন আরসার সদস্য, একজন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা। গত এক বছরে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ৪ শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও ১৬৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ২২২টি অগ্নিকান্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি নাশকতামূলক বা ইচ্ছা করে লাগানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর