পর্দা নামল নিউইয়র্কে শুরু হওয়া জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ অধিবেশনের। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকালে ১০ দিনব্যাপী এ অধিবেশনের সমাপ্তি টানা হয়। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ প্রভাবশালী দেশের চারটির শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতির কারণে অনেকটাই ম্রিয়মাণ ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ প্ল্যাটফরমের এই অধিবেশন। অন্যদিকে, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুটি পুনরায় তুলে ধরাকে বিশেষ অর্জন বলছেন বিশ্লেষকরা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ অধিবেশন শুরু হলেও মূল অধিবেশন শুরু হয় ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, মানবাধিকার কর্মী, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের পদচারণে মুখরিত ছিল নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দফতর প্রাঙ্গণ। এ বছর সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘আস্থার পুনর্নির্মাণ এবং বিশ্বব্যাপী সংহতির পুনরুজ্জীবন’। প্রথম সাত দিন হয়েছে উচ্চপর্যায়ের বক্তৃতা। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯৩টি দেশের নেতারা অংশগ্রহণ করেন। তবে রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মতো চার প্রভাবশালী দেশের শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতে জৌলুস ছিল না অধিবেশনসহ বিভিন্ন সাইড ইভেন্টগুলোর। তবে অন্যবারের মতোই বিদেশি নেতাদের কালো গাড়ির ভিড়ে ম্যানহাটনে রাস্তা পার হওয়াই যেন কঠিন হয়ে পড়ছিল। মূল অধিবেশনে ভাষণের বাইরে অনেক বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভাষণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সপ্তদশবারের মতো ইউএনজিএ অধিবেশনে তিনি বাংলায় ভাষণ দেন।
জাতিসংঘ সদর দফতরের জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিষয় তুলে ধরেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিভিন্ন সংস্থার প্রধানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও সাইড ইভেন্টে অংশ নেন। সেখানে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি তথা বৈশ্বিক বাস্তবতায় অনেক কিছুই অর্জন সম্ভব হয়নি। তবে এটা মানতেই হবে যে, এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্জনের ঝুলিতে অনেক কিছুই জমা হয়েছে। দেশীয় তথা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। অনেকে মনে করেছিলেন, সেখানে নির্বাচন, রাজনীতিই হবে মুখ্য আলোচ্য। কিন্তু না, তা হয়নি।
বরং দেশীয় রাজনীতিকে গৌণ করে বিশ্বমঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য সমস্যাগুলোকে তুলে ধরতে পেরেছেন। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক ফোকাস থেকে অনেকটা হারিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এটেনশন ফিরেয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নিজেকেই মেলে ধরতে পেরেছেন বিশ্বনেতা হিসেবে। তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা হয়েছে সর্বমহলে। যা হয়তো সমালোচকদের গা জ্বালা-ই হবে!
বিশ্বনেতাদের দেওয়া ভাষণের বরাত দিয়ে তারা বলছেন, ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় আশা করা হয়েছিল এই বিশ্ব সংস্থাটি পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, অনুন্নয়ন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঠেকাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যে দেশগুলো জার্মানি ও তার মিত্রদের পরাস্ত করে তারাই এই সংস্থা গঠনের আসল চালিকাশক্তি। কিন্তু তাতে দেশগুলোর বন্ধুত্বে চিড় ধরতে খুব বেশি দিন লাগেনি। শুরু হয়ে গেল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই। যারা যুদ্ধ ঠেকাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারাই যুদ্ধ বাধাতে ছিল সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। দেশে দেশে বিভক্তি তৈরি করে যার যার প্রভাব বলয়ে আনাই ছিল তাদের আসল লক্ষ্য। এরপর ৭৭টি বছর কেটে গেলেও অবস্থা বদলায়নি, বরং বহুগুণে অবনতি ঘটেছে। পাঁচটি দেশকে তাদের সার্বিক গুরুত্বের কারণে এই সংস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ‘ভেটো’ প্রদানের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ এ বছর সেই ৫ দেশের ৪ নেতাই ছিলেন অনুপস্থিত।
