শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবরের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ নেতাদের হোটেল ও বাসভবনে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। পুড়ে যাওয়া এসব ভবন ও স্থাপনা থেকে গতকাল ৪৯ লাশ শনাক্ত করেন স্থানীয়রা। এতে কয়েকজনের পরিচয়ও শনাক্ত করা হয়নি। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে রয়েছে বিস্তারিত-
নাটোর : নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেস থেকে চারটি অগ্নিদগ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে শহরের কান্দিভিটায় শিমুলের বাসভবনের ভিতরে গিয়ে লাশগুলো দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে নিহতের স্বজনরা গিয়ে লাশগুলো শনাক্ত করে নিয়ে যান। নিহতরা হলেন- নাটোর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন খানের ছেলে আকিব খান, তালতলা এলাকার বকুল হোসেনের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সিয়াম হোসেন, বড়গাছা এলাকার আবদুল মজিদের ছেলে শফিকুল ইসলাম মোহন ও মল্লিকহাটি এলাকার ফজের আলীর ছেলে ইয়াসিন আলী।
বরিশাল : নগরের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বাসভবন থেকে উদ্ধার হওয়া তিন লাশের মধ্যে দুজনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। তারা হলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার সঠিখোলা গ্রামের বাসিন্দা মজিবর রহমান জোমাদ্দারের ছেলে মঈন জোমাদ্দার (৪৫) ও নগরের নাজির মহল্লা এলাকার কাঞ্চন ফরাজীর ছেলে নুর ইসলাম নুরু (৪৫)।
কুমিল্লা : নগরীর অশোকতলায় সাবেক কাউন্সিলর মো. শাহ আলমের তিন তলা বাসা থেকে সাতজনের লাশ উদ্ধার করেছেন স্থানীয়রা। গতকাল জানাজা নামাজ শেষে তাদের দাফন করা হয়। নিহতরা হলেন- অশোকতলা এলাকার আশিক (১৪), শাকিল (১৪), শাওন (১২), মাহফুজুর রহমান মুকুল (২২), রনি (১৬) ও মহিন (১৭)। এ ছাড়া আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপির মেয়ে কুমিল্লা সিটি মেয়র তাহসীন বাহার সূচনার স্বামী সাইফুল আলম রনির বাসায় হামলায় নাফিজুল আলম সামি (১৮) নামের একজন নিহত হয়েছেন। এদিকে চৌদ্দগ্রামে পুলিশের গুলিতে জামশেদ নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
দিনাজপুর : দিনাজপুরের হাকিমপুর পৌর মেয়র জামিল হোসেন চলন্তর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর তার বাড়ি থেকে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতদের একজনের নাম সূর্য (২০)। তিনি উপজেলার বড় ডাঙ্গাপাড়া এলাকার মজনুর রহমানের ছেলে। অপরজনের নাঈম (২৩) পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা ইউনিয়নের বাসিন্দা। চুয়াডাঙ্গা : জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দুজন সংসদ সদস্যের বাসভবনসহ আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরেফিন আলম রঞ্জুর বাড়িতে দেওয়া আগুনে পুড়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। যারা সবাই পুরুষ। এদের মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন- আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদহ গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে সাকিব হোসেন (২০) ও শহরের হাটকালুগঞ্জ এলাকার সাইদুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ তাফিম (১৬)।
যশোর : সোমবার বিকালে যশোরে শিক্ষার্থী-জনতার বিজয় মিছিলে ঢুকে পড়া কিছু দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশাল। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত হোটেলটি থেকে একজন ইন্দোনেশিয়ান নাগরিকসহ ২১ জন নিহত হয়েছেন। ১৬ তলাবিশিষ্ট এই পাঁচ তারকা হোটেলটির মালিক যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যশোর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার।
কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন জান্নাত হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আগুন দেওয়ার এক দিন পর তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের লাশ উদ্ধার করেন। তবে নিহতদের কারও নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। হোটেলটির মালিক ভৈরব পৌরসভার পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন মিন্টু।
লালমনিরহাট : শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের খবরের পর উল্লসিত এবং বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আগুন দিতে গিয়ে আগুনে পড়ে ছয় ছাত্র আগুনে পুড়ে মারা যায়। নিহতদের মধ্যে শহরের খাতাপাড়া এলাকার সাইদুর রহমান মিঠুলের ছেলে শ্রাবণ, হাঁড়িভাঙা এলাকার মৃত জাহেদুল ইসলাম খোকনের ছেলে তন্ময়, বানভাষা এলাকার রেজাউল করিম রেজার ছেলে রাজিব, পিংকির মোড় এলাকার বিজিবি কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের ছেলে রুশো এবং নবীনগর এলাকার সেকেন্দারের ছেলে জনিসহ পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত হলেও বাকি এক জনের পরিচয় যানা যায়নি।
‘ফেনীর গণভবন’ রেখেই পালালেন নিজাম হাজারী : শহরের মাস্টারপাড়ায় কয়েক শ কোটি টাকা খরচ করে বাংলোবাড়ি করেছিলেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। হাতিরঝিলের আদলে লেক, হ্যালিপ্যাড, সুইমিং পুল, বার কী নেই সেখানে। কথিত আছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য নেতারা ফেনী-নোয়াখালী এলে নিজাম হাজারীর এ বাড়িতেই সময় কাটাতেন। এ বাড়িতে ভিআইপিরাই শুধু প্রবেশ করতে পারতেন। সে কারণেই স্থানীয়রা একে ‘ফেনীর গণভবন’ বলে জানতেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে নিজাম উদ্দিন হাজারীর বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে উত্তেজিত জনতা। সোমবার বিকাল ৩টার দিকে শহরের মাস্টারপাড়ায় এ হামলা ঘটে। উত্তেজিত জনতা দুপুর থেকে মাস্টারপাড়ায় এমপি নিজাম হাজারীর বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এর আগেই বাড়ি থেকে চলে যান নিজাম হাজারী। এ ছাড়া শহরের বাঁশপাড়ায় সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীলের কার্যালয়, পিটিআই স্কুল, ফেনী পৌরসভা, স্টেশন রোডের জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, দাগনভূঞা-ছাগলনাইয়া থানা ও শহরের আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।