দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ হুমকিতে পড়েছে। এর ফলে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিযোগের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল অ্যানার্জি অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসআরইএ) সূত্রে এমনটি জানা যায়। এদিকে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে বেশ কয়েকটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের আগ্রহপত্র (লেটার অব ইনটেন্ট-এলওআই) বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনার জন্য বিএসআরইএ-এর সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সময় চেয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। জানা যায়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ইস্যুকৃত ৩১টি এলওআই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে- যা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীরা এলওআই-এর ভিত্তিতে আংশিক বিনিয়োগ করেছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে এখান থেকে ২ হাজার ৬৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যা দেশের ভবিষ্যৎ বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে সাহায্য করবে। বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ১ হাজার ৩৭৯ মেগাওয়াট। যার মধ্যে ৫৯৬ মেগাওয়াট ইউটিলিটি স্কেল অনগ্রিড প্রকল্প থেকে আসে।
বাংলাদেশ সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল অ্যানার্জি অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসআরইএ) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদ জানান, বাংলাদেশে ৫০টিরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প উন্নয়ন ও বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে চীন, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ রয়েছে। তিনি বলেন, উল্লিখিত ৩১টি এলওআই প্রাপ্ত বিনিয়োগকারীরা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যার মধ্যে জমি কেনা এবং ৩১টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যান্য পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এলওআই প্রাপ্ত এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেসরকারী খাত থেকে কমপক্ষে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ পেতে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় যদি বিদ্যুৎ বিভাগ উল্লিখিত প্রকল্পগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে প্রত্যক্ষভাবে বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। মোস্তফা আল মাহমুদ আরও বলেন, ইস্যুকৃত ৩১টি নবায়নযোগ্য প্রকল্পের সক্ষমতা ২ হাজার ৬৭৮ মেগাওয়াট। দ্রুতই এসব প্রকল্প থেকে এই ২ হাজার ৬৭৮ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। এ ছাড়াও অ-নবায়নযোগ্য উৎসের ওপর নির্ভরতা কমাতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎসে পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি। বিএসআরইএ-এর সমীক্ষা অনুসারে, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের সঙ্গে তুলনা করলে সরকার নবায়নযোগ্য এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে প্রতিবছর ৯৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব হবে। এতে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি কমে যাবে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাবে।
পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রকল্পগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। বিএসআরইএ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট জাহিদুল আলম বলেন, আমাদের প্রকল্পগুলো যথাযথ প্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে প্রাপ্ত। দেশের উন্নয়নের জন্য এই প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম যাতে অব্যাহত থাকে এ জন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা করছি। এই প্রকল্পগুলোতে কোনো ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জের প্রয়োজন নেই। ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত হওয়ায় সরকারের বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থও সাশ্রয় হবে।’জ্বালানি খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. জাকির হোসেন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার সম্প্রতি যে ৩১টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমার মতে কেস ধরে ধরে এগুলোর ব্যাপারে মূল্যায়ন করা উচিত। এই চুক্তিগুলো বাতিল করে দেওয়ার আগে একটি মূল্যায়ন করে যদি বাতিল করা হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারী বুঝতে পারবে কী কারণে আমরা এই চুক্তিগুলো বাতিল করেছি। এটি তাদের কাছে হতে পারত একটি ভালো সিগন্যাল। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ ধরনের আশঙ্কার মধ্যে যাতে না থাকেন যে, এখানে তারা বিনিয়োগ করতে এসেছেন কিন্তু পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের চুক্তিও বাতিল হয়ে যাবে। এই অনিশ্চিয়তা তৈরি করা ঠিক হবে না।
বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস ও ক্লিন অ্যানার্জি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় ওই ৩১টি প্রকল্প বাতিল করা হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।