রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ওইসব টাকা পাচারের অভিযোগে ৩৩টি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মামলাও করেছে সংস্থাটি। এদের অধিকাংশই ঢাকা ও গাজীপুরে অবস্থিত। এসব প্রতিষ্ঠানের ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে টাকা পাচারের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাস্টমস গোয়েন্দারা গত বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে তিন ধাপে ছয় মাসের তদন্তের পর ওইসব জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন করে। সূত্র জানায়, এসব গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত। ওই সময়ে টাকা পাচারের ঘটনাগুলো ঘটে। এসব প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এনেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। বাকি ৮২১ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার হয়েছে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করে।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নথি বিশ্লেষণ করে জানতে পারেন, পণ্য রপ্তানি করতে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ কম মূল্য দেখানোর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যকে ‘নমুনা’ পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ কারণে এসব পণ্যের বিপরীতে দেশে কোনো টাকা প্রবেশের সুযোগ নেই। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব টাকা পাচারের সঙ্গে একাধিক চক্র জড়িত। ঢাকাভিত্তিক বায়িং হাউস এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন ২০২২ সালে ৩০৮ কোটি টাকার (২৮ মিলিয়ন ডলার) মূল্যের ১৪ হাজার ৮৫ টন টি-শার্ট ও প্যান্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে পাঠিয়েছে। তবে এ চালানের বিপরীতে একটি ডলারও দেশে আসেনি। রপ্তানি নথিতে কোম্পানিটি ১ হাজার ৩৪২টি চালানের সবই ‘নমুনা পণ্য’ হিসেবে দেখিয়েছে। শুল্ক নিয়ম অনুযায়ী, নমুনা পণ্যের কোনো রপ্তানি আয় দেশে আসে না। একইভাবে গাজীপুর ভিত্তিক রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হংকং ফ্যাশন ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের মে মাসের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও মালয়েশিয়াসহ ৭টি দেশে ৪৩ দশমিক ২১ কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ১৬০ টন পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে মাত্র ১২ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা এনেছে। বাকি ৩০ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
সূত্র জানায়, পাচার হওয়া ৮২১ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। বাকিগুলো কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কাতার, স্পেন, কুয়েত, ফিলিপাইন, সুইডেন, রাশিয়া, পানামা, থাইল্যান্ড, জর্জিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলসহ ২২টি দেশে পাঠানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি নথিতে অন্তত ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নাম ব্যবহার করেছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, পাচার হওয়া ৮২১ কোটি টাকার মধ্যে রপ্তানির নামে ১০টির মতো আরএমজি কারখানা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। আর টাকা পাচারের জন্য ওই প্রতারকরা এনবিআর সার্ভারে কোড-২০ ব্যবহার করে, যা প্রকৃত রপ্তানির আগে আমদানিকারকদের কাছে ‘নমুনা’ প্রেরণকে নির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের প্রশ্নই আসে না। কাস্টমস গোয়েন্দারা বলছেন, টাকা পাচারের আরেকটি জনপ্রিয় উপায় হলো আন্ডার ইনভয়েসিং বা প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো বা পণ্যের পরিমাণ কম দেখানো। ওই ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টি প্রতিষ্ঠানই এ উপায়ে টাকা পাচার করেছে। এগুলোর মধ্যে এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন, সাবিহা সাইকি ফ্যাশন, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন এবং ইলহাম ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ১ হাজার ৭৮০টি চালান পাঠানোর জন্য কোড ২০ ব্যবহার করেছে। যদিও সাধারণত নমুনা পণ্য ১০ কেজি থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত হয়। এই চালানের প্রতিটির ওজন ছিল ১০ হাজার কেজির বেশি। সঠিকভাবে তদারকি বা যাচাই-বাছাই না করার কারণে এসব চালান কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যেতে পেরেছে।
আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাকি ২৯ রপ্তানিকারক ৫৫৪ কোটি টাকার ১৪ হাজার ৮৭৮ টন গার্মেন্ট পণ্য পাঠালেও তারা রপ্তানি আয় দেখিয়েছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা।
তাদের পণ্যে একটি টি-শার্টের গড় দাম দেখানো হয়েছে ১২ টাকা থেকে ২১ টাকা এবং এক জোড়া প্যান্টের দাম দেখানো হয়েছে ১৭ থেকে ৫৪ টাকা, যা প্রকৃত দামের চেয়ে ৪ থেকে ১০ গুণ কম। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ ফখরুল আলম গতকাল এ প্রতিবেদককে জানান, রপ্তানির আড়ালে ৮২১ কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের তদন্তও হচ্ছে।