ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার সরকারের পতনের তিন মাসে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা রকম পরিবর্তন ও সংস্কার শুরু হলেও বাজারব্যবস্থায় ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন আসেনি। বাজারব্যবস্থার সিন্ডিকেট ভাঙার মতো কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই নিতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। মাঠপর্যায় থেকে পাইকারি, আড়তদার, খুচরা বাজারের কোথাও কোনো স্বচ্ছতা, জবাবদিহির বালাই নেই। খোদ অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, বাজারে বিশৃঙ্খলার কারণে পণ্যের দাম কমছে না। মানুষ অধৈর্য হয়ে গেছে। এটাই অস্বাভাবিক। পণ্য আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ছাড় দিলেও এর সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এখনো সেই পুরনো ধাঁচেই চলছে ঢিলেঢালা মনিটরিং। মনিটারিং টিম যতক্ষণ বাজারে থাকে ততক্ষণ পরিস্থিতি কিছুটা ঠিক থাকে। তদারকি টিম চলে গেলে আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে যায়। ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পণ্য পরিবহন ও বাজারব্যবস্থায় চাঁদাবাজি কিছুটা স্তিমিত হলেও এখন সেটা আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এ ক্ষেত্রে শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমদিকে কিছুটা চেষ্টা করলেও তাতে সফল হতে পারেনি। চাঁদাবাজদের কাছে এক রকম অসহায়ত্ব বরণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পণ্যের দাম না কমায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে অসন্তোষ। যা এ সরকারের প্রতিও তিক্ততা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শক্ত ব্যবস্থা না নিতে পারলে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা মোটেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী কিংবা অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, একটা জবাবদিহিমূলক বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এর সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ইথিক্যাল হতে হবে। যারা সিন্ডিকেট করেন বা অধিক মুনাফা করেন এবং চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অবশ্য এই কাজটা কোনো সরকার কখনই করতে পারেনি। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বর্তমান এ সরকার এ বিষয়ে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। বাজারের এই সিন্ডিকেটের পেছনে পতিত সরকারের দোসররা এখনো কার্যকর রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের তিক্ততা ও আস্থাহীনতা ছড়িয়ে দিতে একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছে বলে মনে করেন খোদ বাণিজ্য উপদেষ্টা। নিয়োগ পাওয়ার পরদিনই হোটেল সোনারগাঁওয়ের একটি অনুষ্ঠানে শেখ বশির উদ্দিন বলেন, আমরা বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলবই। এদিকে গত এক মাসে চাল, ডাল, তেল, পিঁয়াজ, রসুন, সবজি, মাছ, মুরগি, ডিম, দুধসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। কিন্তু পণ্যের দাম না কমলে মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবে গত এক মাসে মোটা চিকন সব ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অবশ্য এটার জন্য সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিকে কিছুটা দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে চালের মজুত সাড়ে ৮ লাখ টনের নিচে নেমে এসেছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে চাল আমদানির প্রয়োজন হতে পারে। এদিকে আলুর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে। যার কোনো ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই। পুরনো আলু যেগুলো ব্যবসায়ী ১২-১৫ টাকায় কিনে মজুত করেছেন সেই আলু ৫০ টাকার নিচে কোল্ড স্টোরেজ থেকে বেরই করছেন না। ফলে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ৭০ টাকায় উঠেছে। অথচ এই আলুর দাম ৩০ টাকার বেশি হওয়ার কোনো যুক্তিই নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এর বাইরে মসুর ডাল, মাছ, মাংস, শাকসবজি কোনোটারই দাম কমছে না। বরং প্রতিদিনই বাড়ছে। অকারণেই বাড়ছে। পিঁয়াজ-রসুনের দাম তো আকাশচুম্বী। এক কেজি পিঁয়াজ এখনো ১২০ টাকা। এক কেজি রসুনের দাম ২২০-২৪০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি পিঁয়াজে দাম বেড়েছে ২২ টাকা। আর রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে অন্তত ১৯ টাকা। আদার দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। টিসিবির তথ্যমতে, সয়াবিন, পামওয়েল, সরিষাসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম গত এক মাসে লিটারপ্রতি ১ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পামওয়েলের দাম। পণ্যটির দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দামও লিটারপ্রতি বেড়েছে ৯ টাকা। বাজারব্যবস্থা সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যশা অনেক বেশি। কিন্তু এ সরকার কাজের চেয়ে কথা বেশি বলছে। মাঠে যাচ্ছে না। মাঠে যাওয়া প্রয়োজন। সমস্যার মূলে যেতে হবে।
অন্যথায় আমরা বাজারব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হব। উচ্চ পণ্যমূল্যের কারণে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত আগস্টে খাদ্য খাতে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল, সেপ্টেম্বরে তা ছিল ১০ দশমিক ৪০; আর অক্টোবরে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি।