বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক নিয়ে দরকষাকষিতে পিছিয়ে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি। যখন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করার সুযোগ ছিল তখন এ ইস্যুকে খুবই সহজ করা হয়েছিল। কিন্তু ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের সময়সীমা ওঠে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় চিঠি পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ সরকার। তখনো ইউএসটিআরের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা করতে পারেনি বাংলাদেশ থেকে পাঠানো প্রতিনিধি। পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরও বেশি অস্বাভাবিক হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন ছুটে যান ওয়াশিংটনে। সে সময়ও তিনি কোনো ব্যবসায়ী প্রতিনিধি সঙ্গে নিয়ে যাননি। অথচ এই একই সময়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অনেক প্রতিযোগী দেশ নেগুশিয়েশন করে ফেলেছে। সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বাণিজ্য সচিব মাহাবুবুর রহমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন,
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জীবনে এরকম বেকায়দায় পড়েনি। এরকম পাল্টা শুল্ক তো সব সময় আরোপ করা হয় না। ১৯৪৭ সালের পর কয়বার এসেছে? আমাদের মূল অবস্থানপত্র আমরা দিয়ে দিয়েছি।
জানা গেছে, ইউএসটিআরে শুনানির সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। সংস্থাটির সঙ্গে যুক্তিতর্কে সম্ভাব্য কোনো সমাধানের পথও বের করা সম্ভব হয়নি। এজন্য এখন শেষ মুহূর্তে এসে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে সরকারের ভিতরে ও বাইরে। এমনকি ব্যবসায়ীরাও হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। কেননা ১ আগস্ট থেকে নতুন ট্যারিফ কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। অথচ তৃতীয় দফা আলোচনার জন্য এখন হন্যে হয়ে শিডিউল খোঁজা হচ্ছে ইউটিআরের কাছে। সংস্থাটি শিডিউল না দেওয়ায় এখন একটি ‘অবস্থানপত্র’ পাঠানো হচ্ছে। তবে সেটাও এখনো প্রস্তুত হয়নি। ফলে এ অবস্থানপত্র পাঠাতেও আরও সময় নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ অবস্থানপত্র তৈরিতেও রীতিমতো ঘাবড়ে গেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টা এ নিয়ে প্রায় ৫ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। গতকাল নিজ দপ্তরে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে বিকাল ৪টায় বৈঠকে বসে রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে বাণিজ্য সচিব মাহাবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অবস্থানপত্রের ইস্যু সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। আমরা সবার মতামত নিয়ে একটি খসড়া করেছি। এটা চূড়ান্ত করতে আরও এক দিনের প্রয়োজন হবে। আমরা আরও সময় চাচ্ছি। এগুলো সবই নন ডিসক্লোজার চুক্তি। সব আইটেম নিউজও না। ফলে অবস্থানপত্রে কী বার্তা বা কী ধরনের দাবি থাকছে- তা এখনো পরিষ্কার নয়। তিনি বলেন, আমরা দু-এক দিনে আবার ওয়াশিংটনে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাদের বলেছেন, শিডিউল না নিয়ে আসবেন না। ইউএসটিআর আমাদের শিডিউল দিলে তারপর যাওয়া হবে। আর যে কোনো চুক্তি করতে হলে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন লাগবে। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। ফলে আমরা এটার জন্য আরও সময় নিচ্ছি।
এদিকে আগামী পাঁচ বছরে ৭ লাখ টন করে গম আমদানির জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সরকারিভাবে এ গম আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে আস্থা এবং পারস্পরিক বাণিজ্য সহযোগিতার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে। জানা গেছে, আগামী পাঁচ বছর প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে ৭ লাখ টন উচ্চমানের গম আমদানি করা হবে। জানা গেছে, দেশটির বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরের সঙ্গে তৃতীয় দফায় আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে। তবে শুধুই আলোচনা নয়, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের চেয়ে আন্তআঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও হয়েছে। শুল্ক কমাতে হলে আরও একাধিক নন ডিসক্লোজার চুক্তি চায় ট্রাম্প প্রশাসন। অন্তর্বর্তী সরকার এতে সম্মত না হলে শুল্ক আরও বাড়তে পারে। অতিরিক্ত চাপ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ইতোমধ্যে সতর্ক সংকেতও দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহের সোমবার বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব বিষয়ে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর ব্যবসায়ীদের সামনে রেখে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন শেখ বশির উদ্দীন; যা ছিল শুধুই নিয়ম রক্ষায়। ওই ব্রিফিংয়ে তিনি ওয়াশিংটনে কী ধরনের আলোচনা হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি।
আলোচনার অগ্রগতি কী, ওয়াশিংটন বা ইউএসটিআর কী ধরনের শর্ত দিয়েছে; কিংবা আন্তআঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না এ-সংক্রান্ত সব প্রশ্নই তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ ওইসব ইস্যু নিয়েই ইউএসটিআরের সঙ্গে দরকষাকষি হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষে আসার মতো নমনীয় ভাব দেশটি এখনো দেখায়নি। এসব বিষয় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের অবহিত করেছেন শেখ বশির উদ্দীন। তবে আন্তআঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু বলতে যুক্তরাষ্ট্র কী বোঝাতে চাচ্ছে? এর অধীনে কী কী বিষয় প্রাধান্য পেতে পারে। ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে কী বিষয়বস্তু যুক্ত হতে পারে, সেসব বিষয়ে ব্যবসায়ীদেরও বলা হয়নি। এ ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জীবনে এরকম বেকায়দায় পড়েনি : বৈঠকের পর বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘আমাদেরকে তারা যে ২১ পৃষ্ঠার ডকুমেন্টটা দিয়েছে সেটা নিয়েই কাজ করছি। গত বুধবার একটা বৈঠক ছিল। আজকে আবার বৈঠক করলাম। আমাদের শিগগিরই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা বলেছে সময় না নিয়ে এসো না। তারা ১৫৪টা দেশের সঙ্গে কাজ করছে। আমরা কালকে মেইল দেব। আমরা এর সঙ্গে অবস্থানপত্রটাও দেব। আমরা সেখানে গিয়েই আলোচনা করব। এটা বলা সম্ভব না। এটা কাউকে বলি নাই। আমরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনের বাইরে কিছুই করছি না। বাংলাদেশ কোনো একটা চুক্তি করতে গেলে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। ল মিনিস্ট্রির ভেটিং লাগবে। আমাদের সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সব আইটেম সব সময় নিউজ আইটেম নয়। কমার্স মিনিস্ট্রি জীবনে এরকম বেকায়দায় পড়েনি। এরকম পাল্টা শুল্ক তো সব সময় আরোপ করা হয় না। ১৯৪৭ সালের পর কয়বার এসেছে? আমাদের মূল অবস্থানপত্র আমরা দিয়ে দিয়েছি।’