আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের প্রথম ভোট ধানের শীষে চাইলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান। তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তারুণ্যের প্রথম ভোট, ধানের শীষের জন্য হোক।’ বিএনপির এই শীর্ষনেতা বলেন, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ ও চরমপন্থার উত্থান কিংবা পুনর্বাসন ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল বিকালে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সমাবেশে প্রধান অতিথির ভার্চুয়ালি বক্তব্যে তারেক রহমান এই আহ্বান জানান। জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই সমাবেশের আয়োজন করে ছাত্রদল।
ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরের পরিচালনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ও ড. আসাদুজ্জামান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সমাবেশকে কেন্দ্র করে শাহবাগ মোড়ে টিএসসির দিকে মুখ করে মঞ্চ তৈরি করা হয়। শাহবাগ মোড় থেকে একদিকে মৎস্য ভবন, অন্যদিকে কাঁটাবন মোড় এবং সামনের দিকে চারুকলা ইনস্টিটিউট পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সমাবেশের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মী এসে যোগ দেন সমাবেশে। সকাল থেকে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতা-কর্মীদের ভিড় বাড়তে থাকে। খণ্ড খণ্ড মিছিল এসে মিলে শাহবাগে। থেমে থেমে নেতা-কর্মীরা স্লোগান দেন। কারও হাতে ছিল জাতীয় পতাকা, আবার কারও হাতে দলীয় পতাকা।
এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, বিগত সরকার ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। দেশের প্রায় ১৩ কোটি ভোটারের মধ্যে গত দেড় দশকে ৪ কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ চক্র তরুণদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল।
ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তোমাদের হারানো ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
বিএনপি তারুণ্য ও নারীর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবে বলে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, বিভেদ-প্রতিহিংসার রাজনীতি আর নয়, দেশের জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গুণগত রাজনীতি দেখতে চায়। দলের এই শীর্ষনেতা বলেন, দেড় দশকের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী হতাহত হয়েছেন। সমাবেশে তরুণদের কাছে ‘ধানের শীষের জন্য ভোট’ চান তারেক রহমান। তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তারুণ্যের প্রথম ভোট, ধানের শীষের জন্য হোক।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, জনগণের রায়ে দেশের ক্ষমতার দায়িত্ব পেলে বিএনপি শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ই-কমার্স নিয়ে কাজ করবে। আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেবে। খেলাধুলা ও আর্ট কালচারকে শিক্ষা কারিকুলামে নিয়ে আসবে। ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘সাহস ও সততার সঙ্গে এগিয়ে গেলে দেশের জনগণ তোমাদের সঙ্গে থাকবে।’
বাংলাদেশে বিভক্তি সৃষ্টির অনেক চেষ্টা হচ্ছে : ফখরুল
বাংলাদেশের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির নানা চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা আর কোনো দিন এ দেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে রাজনীতি করতে দেব না। এ বিষয়ে সমাবেশ থেকে আমাদের শপথ নিতে হবে। কারও কাছে মাথা নত না করার শপথ নিতে হবে। আমরা নিজেরাই নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলব।’
শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, দেশে ‘হেলমেট বাহিনী ছাত্রলীগের’ কোনো অবস্থান থাকতে পারে না। জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষকে শিখিয়েছে, দেশে কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারের স্থান হতে পারে না। জুলাই আন্দোলনের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হলে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ছাত্রদলকে রুখে দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। দেশকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায় ছাত্রদল তাদের ‘বিষ দাঁত’ উপড়ে ফেলতে পারে। ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান নির্দেশ দিলে সারা দেশ অবরোধ কার্যকর করতে পারবে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।
শাহবাগের সমাবেশ থেকে ছাত্রদলের ৯ দফা : চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ৯ দফা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয়েছে। রাজধানীর শাহবাগে ছাত্র সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ছাত্রদলের সভাপতি এই প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দেন।
দফাগুলো যথাক্রমে ১. শিক্ষাঙ্গনে গেস্টরুম নির্যাতন, গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করে এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের মতো ঘৃণিত চর্চার স্থায়ী বিলোপসাধন এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে ছাত্রদল সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে; ২. ক্যাম্পাসে ও আবাসিক হলে প্রশাসন কর্তৃক শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ আবাসন, পুষ্টিকর খাদ্য, বাসযোগ্য কক্ষ এবং পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছাত্রদল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে; ৩. ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি জনকল্যাণমুখী, পরমতসহিষ্ণু, উদার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ছাত্রদলের প্রতিটি নেতা-কর্মী নিবেদিত থাকবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্র গঠনের সব পর্যায়ে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এবং নারীদের জন্য শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ছাত্রদল কর্তৃক জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে; ৪. স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থের সুরক্ষা এবং জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আধিপত্যবাদবিরোধী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী চিন্তার সন্নিবেশনে রাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশপন্থি সর্বজনীন শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম প্রণয়নের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ছাত্রদল; ৫. বেকারত্ব দূরীকরণের রাষ্ট্র কর্তৃক কর্মমুখী ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে ছাত্রদল জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করবে। পাশাপাশি সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব ধরনের একাডেমিক এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস রোধ এবং এ সব পরীক্ষাব্যবস্থাকে দুর্নীতি ও জালিয়াতি মুক্ত করতে ছাত্রদল সোচ্চার ভূমিকা পালন করবে; ৬. মাদকমুক্ত ক্যাম্পাস এবং মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ছাত্রদল অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে; ৭. ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৬৯, ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভাবধারার সাংস্কৃতিক চর্চা বেগবান করার লক্ষ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে ছাত্রদল; ৮. শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ছাত্রদল জোরালো ভূমিকা রাখবে; ৯. বাংলাদেশে যেন আর কখনো ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে ছাত্রদল সদা সোচ্চার থাকবে এবং একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ভোটাধিকার ও সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা নিশ্চিত করতে আপামর ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে নিরন্তরভাবে কাজ করে যাবে।