ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে সংশয় অনেকটা কেটে গেছে। ইলেকশন ট্রেনে উঠে গেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারের প্রস্তুতি ব্যাপক। অন্তহীন ব্যস্ত নির্বাচন কমিশন। জীবনের সেরা কাজটি করতে চান বলে অভিপ্রায় জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে মানুষ। আগামী দিনের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতাসহ অনেক কিছু নির্ভর করছে এ নির্বাচনের ওপর। বিশেষ করে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীদের
যাবতীয় অপেক্ষা আসন্ন নির্বাচনটি ঘিরে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি সরকারের বিকল্প নেই। আরও পরিষ্কার করে বললে নির্বাচনের চেয়ে ভোট বেশি প্রাসঙ্গিক। নির্বাচন আর ভোট এক কথা নয়। বিগত সরকারটি নির্বাচন দিয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে রাতে, দিনে, ডামি-আমিতে, নৌকা-ঈগল-ট্রাকে অনেক নির্বাচনি সার্কাস দেখিয়েছে। কিন্তু ভোট দিতে দেয়নি মানুষকে। স্থানীয় সরকার ও বিভিন্ন পেশাজীবী, বিজনেস কমিউনিটি, ক্রীড়াঙ্গন, এমনকি বাজার-মাজার-মসজিদ কমিটিতেও ভোট মানুষকে ভুলিয়েই দেওয়া হয়েছে। এবার নির্বাচনি হুইসেলের সমান্তরালে ভোটের বাদ্যও বেশ বাজছে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার বলেছেন ইতিহাসের সেরা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে চান তিনি। নির্বাচন কমিশনাররা বলেছেন এবারের নির্বাচনটি হবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। এ চ্যালেঞ্জে তাঁদের জিততেই হবে। নইলে ভবিষ্যতে জবাবদিহি করতে হবে, এ বার্তা তাঁরা পেয়েছেন। পরিণতিটা সবার সামনে। সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এখন কারাগারে। দেশে এখন নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যে হট্টগোল, তর্কবিতর্ক চলছে, একে ইতিবাচকভাবে নেওয়া যায়। তা নির্ভেজাল নির্বাচন ও সুষ্ঠু ভোটের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তো।
এ অবস্থা উত্তরণে চমৎকার একটি নির্বাচন এবং নির্বিঘ্নে ভোটই একমাত্র দাওয়াই। যথারীতি সেই ছন্দ-আনন্দের ছটা স্পষ্ট। জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে আসনভিত্তিক প্রার্থী চূড়ান্তকরণে ব্যস্ত। কেউ পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে, কেউবা যাচাইবাছাইয়ে। লক্ষণ বিচারে এটি শুভ। বর্তমানে ইসির নিবন্ধন তালিকায় ৫০টি দল রয়েছে। নতুন আরও ৬টি দলের নিবন্ধন প্রায় চূড়ান্ত। আগামী নির্বাচনে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল ভোটে অংশগ্রহণের নমুনা মিলছে। এতে ভোটের ময়দান জমে ওঠার যাবতীয় লক্ষণ খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে।
এর পরও কিছু ভয় থেকে যাচ্ছে। মব ভায়োলেন্স দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা, ব্যবসা-বিনিয়োগ, আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা, এমনকি সামনের নির্বাচনও ঝুঁকিপূর্ণ করে দিতে পারে বলে শঙ্কা ঘুরছে এখনো। চলছে কিছু কানাঘুষা। আজ এখানে, কাল সেখানে নানান ধাঁচের মবকাণ্ড; যার বেশির ভাগই এলোমেলো বিক্ষিপ্ত, কূলকিনারাহীন। একটির ন্যূনতম নিষ্পত্তি ছাড়াই আরেকটি। একই সঙ্গে ইস্যু পয়দা। এ নিয়ে নানান ন্যারেটিভ। দোষারোপের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকেও টেনে আনার নোংরা উৎসব।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতা নেওয়ার আগেই প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, তাঁর কথা শুনতে হবে। আস্থা রাখতে হবে। নইলে তিনি দায়িত্ব নেবেন না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কথা ছিল আরও স্পষ্ট। তিনি সবাইকে ধৈর্য ধরা ও শান্ত থাকার আহ্বানের সমান্তরালে বলেছিলেন, ‘আমার প্রতি ভরসা রাখুন।’ দেশ গণতন্ত্রের অভিযাত্রার দিকে নিয়ে যেতে যত সহায়তা দরকার তাঁর বাহিনীকে নিয়ে সব করবেন বলে আশ্বাসও দিয়েছেন। এমনকি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে করণীয় সব করার কথাও দিয়েছেন। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর চেষ্টা ও আন্তরিকতার যাবতীয় সব স্পষ্ট করেছেন। নির্বাচন কমিশন কেবল ‘ফেব্রুয়ারিতে নয়, ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই’ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা নিয়ে ব্যস্ত। সেনাবাহিনীর দায়িত্বও প্রায় স্পষ্ট করা হয়েছে। অপেক্ষা কেবল ফেব্রুয়ারির। কিন্তু কদিন ধরে আজ এখানে, কাল সেখানে ভজঘট পাকানো হচ্ছে। ঘটনার চেয়ে কখনো কথার খই বেশি। ব্যাপক হম্বিতম্বি। কেউ নির্বাচনের আগেই এ সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করে আজই পারলে ফেলে দেয়। কেউ অযাচিত-অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনে সরকারকে। অকথ্য সব কথাবার্তা। সেই সঙ্গে মবের তেজে মাত্রা যোগ করার যত নোংরা আয়োজন। সমান্তরালে উসকানি। আরেকটি ঘটা বা ঘটানোর টোটকা উসকানি। আর এ চান্সে সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা। সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করা। কাজে বা চেষ্টায় অকুলান হলেও সরকার সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থানে। সেনাবাহিনীর অবস্থানও পরিষ্কার। জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা আনতে সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান তাদের।
সেনাবাহিনী কী করছে, কী করবে এ নিয়ে গল্প, কামনা, ধারণা, অনুমানের কিছু অবশিষ্ট নেই। তা আরও পরিষ্কার করা হচ্ছে বাহিনীটির ব্রিফিংগুলোতে। বাকিটা যার যার বোধবুদ্ধিতে বুঝে নেওয়ার বিষয়। এ নিয়ে বাড়তি কথা বা মনগড়া ন্যারেটিভ একদম নিরর্থক। এ মেসেজ ক্লিয়ার। সেনাবাহিনীর এখন যাবতীয় প্রস্তুতি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। সরকার থেকে তাদের নির্বাচনে সংযুক্ত থাকার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। অপেক্ষা কেবল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আনুষ্ঠানিক নির্দেশনার। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে অনেকটা আওয়াজ ছাড়াই। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও শো আপ, হাঁকডাক বা বলপ্রয়োগে না গিয়ে নিজস্ব স্টাইলে সেনাবাহিনী এ অভিযানে অংশীজন হয়েই থাকছে। চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তীতে খোয়ানো ৮০ শতাংশের বেশি অস্ত্র এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ উদ্ধারের জাল ফেলা হয়েছে। মবের বিরুদ্ধে বিশেষ অ্যাকশনের ছকও চূড়ান্ত। যেখানেই মব বা পান্ডামির তথ্য পাচ্ছে, সেখানেই দ্রুত ছুটছেন সেনাসদস্যরা। শিগগিরই এতে আরও মাত্রা যোগের পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত।
গুজবের বিরুদ্ধেও কিছু অ্যাকশনের পরিকল্পনার তথ্যও রয়েছে। গুজববাজরা দিনে দিনে যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তা বড় রকমের শঙ্কা জাগাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত এরা কোন অবস্থা করে ছাড়ে বলা যায় না। মনমতো না হলে এরই মধ্যে যাকে-তাকে নাস্তানাবুদ করে মানইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দিতে শুরু করেছে। যাচ্ছেতাই শব্দ-ভাষা। লেখা বা উচ্চারণের অযোগ্য হলেও তারা তা দিব্বি করে যাচ্ছে। তাদের অবস্থান দেশে-বিদেশে দুইখানেই। তবে নির্দিষ্ট ঠিকঠিকানা, আড়ত বা মোকাম নেই। হালে তাদের স্পেশাল টার্গেট সেনাপ্রধান ও তাঁর বাহিনী। টার্গেটমতো প্রতিদিনই সেনাবাহিনী সম্পর্কে অসত্য, অরুচিকর, নিম্নমানের গুজব ছড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভরসা ফেসবুকসহ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া।
অনেকটা লাস্ট ওয়ার্নিংয়ের মতো সেনাবাহিনীর এ ধরনের অবস্থান ব্যাখ্যা করার ফল মিলতে শুরু করেছে। নতুন করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। জানানো হয়েছে, জানমালের ক্ষতিসাধন, মব ভায়োলেন্স এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন যে কোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপে নামবে। জনমানুষের প্রত্যাশা সেটাই। অধীরভাবে সেই অপেক্ষাই করছে মানুষ। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় মাদকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কয়েকটি অভিযান মানুষকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছে।
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তাসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে রুটিন ওয়ার্কের পাশাপাশি এ কাজগুলো ছিল সময়ের দাবি। এর বাইরে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং বলপ্রয়োগে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাসদস্যদের কাজের ভলিউম অনেকেরই অজানা। সেদিন গাজীপুরের শ্রীপুরে এক ব্যবসায়ীকে অস্ত্রসহ আটক করার সময় স্থানীয়দের রোষানলে পড়া র্যাবকে গিয়ে উদ্ধারও করতে হয়েছে। আর এসব কাজ করতে গিয়ে তাদের সমন্বয় রাখতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
নির্বাচনমুখী ভাব সবার মাঝেই। সংস্কার, ফ্যাসিস্টের বিচার, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান মতভিন্নতা অচিরেই কাটবে। কাটতেই হবে। নিশ্চয়ই কেউ পেছন ফিরে যেতে চায় না। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, তা সবারই বোধগম্য। মাঝে কয়েক দিন কিছু উড়া কথা ঘুরলেও এখন কারও মাঝে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ভাবনার তথ্যও নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে সিইসির সর্বশেষ ব্রিফিংটি বেশ প্রাসঙ্গিক। ফাউল গেম বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বলেছেন, ‘সব খেলোয়াড় (নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল) যদি এ ফাউল (নিয়মবহির্ভূত কাজ) করার নিয়তে মাঠে নামে, তাহলে রেফারির (ইসি) পক্ষে তো এ ম্যাচ পণ্ড হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। সুতরাং খেলোয়াড়দের তো ফাউল করার নিয়ত থেকে একটু দূরে থাকতে হবে।’ সিইসি এও বলেছেন, ‘আমাকে কেউ এ পর্যন্ত বলেন নাই যে আমি ফাউল খেলার নিয়তে ইলেকশনে যাব, ইলেকশনে ভোট ডাকাতি করব, সন্ত্রাস করব-এমন কেউ, কোনো রাজনীতিবিদ বলেন নাই।’
এর আগে বুধবার নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ১১৫টি প্রতীক সংরক্ষণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। সেখানে শাপলা প্রতীক নেই। শাপলা প্রতীক নাগরিক ঐক্য কিংবা এনসিপি কেউ পাচ্ছে কি না-এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘সেটা তো বলি নাই আমি।’ শাপলা প্রতীক না দেওয়া হলে কীভাবে নির্বাচন হবে, এনসিপির এক নেতার এমন মন্তব্যে ইসি কোনো হুমকি অনুভব করছে কি না-এমন প্রশ্নে সিইসি বলেন, ‘এটা হুমকি মনে করি না। কারণ ওনারা তো দেশদ্রোহী না, ওনারা দেশপ্রেমিক। ওনারাও দেশের মঙ্গল চান। দেশের ভালো চান এবং যে ধরনের কর্মকাণ্ড করলে দেশের মঙ্গল হবে, সেটা ওনারা বোঝেন। আমি এটাকে কোনো হুমকি মনে করি না।’
জাতীয় পার্টি নিয়ে সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাননি তিনি। প্রশ্ন ছিল, ইসির আসন্ন সংলাপে জাতীয় পার্টিকে রাখা হবে কি না? কথার পাণ্ডিত্যে না গিয়ে সাবলীলভাবেই তিনি জবাবে বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি পাঁচটা পাইছি ভাই, আমি। আপনারা কটা পাইছেন জানি না।’ এ প্রসঙ্গে সিইসি আরও বলেন, ‘জাতীয় পার্টি বললে আমি একটু কনফিউজড (বিভ্রান্ত) হই। কারণ ওখানে অন্তত হাফ ডজনের মতো হবে এবং লাঙ্গলের দাবিদারও একাধিক, এজন্য আমি বুঝতে পারতেছি না।’ একজন সিইসির এমন সাবলীলতার মাঝেও ভোটের ট্রেনের ছুটে চলা এবং ইলেকশনে আগামীর সলিউশনের বার্তা মেলে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন