ডাক্তার বা রেডিওলজিস্টের পক্ষে নিখুঁতভাবে জটিল রোগের সার্বিক চিত্র পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে এবার এমন সব ‘সেল্ফ লার্নিং সফটওয়্যার’ তৈরি করা হচ্ছে, যা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটাতে পারে।
বিশেষ করে জটিল রোগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে চিকিৎসাবিদ্যায় হাইটেক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে চলেছে। যেমন ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিস্তারিত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। ডাক্তাররা সেই ছবি বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পান।
মেডিএয়ার কোম্পানির কর্ণধার আন্দ্রেয়াস লেমকে বলেন, ‘আজকাল সেইসব ছবি বিশ্লেষণ করার জন্য রেডিওলজিস্টের হাতে খুব কম সময় থাকে। প্রত্যেক রোগীর জন্য বড়জোর ১০ মিনিট। অথচ তাকে ২০০ থেকে ৪০০ ছবি দেখতে হয়। অর্থাৎ নিছক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি ছবিগুলোর ওপর চোখ বোলাতে পারেন। অন্যদিকে আমাদের সফটওয়্যার প্রতিটি ছবির প্রতিটি পিক্সেল বিশ্লেষণ করে এবং মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কাঠামোর অবস্থা তুলে ধরে।’
এই সফটওয়্যারের নেপথ্যে ‘মেশিন লার্নিং’ প্রযুক্তি কাজ করে। এক অ্যালগোরিদম বিশাল পরিমাণ তথ্যের মেলবন্ধন ঘটায়। সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে এক কম্পিউটার মস্তিষ্কের মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস অথবা ডিমেনশিয়া শনাক্ত করতে পারে। যত বেশি ও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে, ফলাফলও তত নিখুঁত হবে।
বার্লিনের এক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এমন এআই প্রোগ্রাম করেছে, যা এমনকি কোনো ডাক্তারের তুলনায়ও বেশি দক্ষ। আন্দ্রেয়াস লেমকে বলেন, ‘প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি অংশ আমরা আরও বেশি করে স্বয়ংক্রিয় করে তুলছি। আরও বেশি সফটওয়্যার সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তথ্য বিশ্লেষণ করছে। সবশেষে রেডিওলজিস্ট শুধু সফটওয়্যারের নির্দিষ্ট কিছু তথ্য পরীক্ষা করবেন। বাকি কাজ সফটওয়্যার করে দেবে।’
কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রেও এমন সফটওয়্যার কাজে লাগানো হচ্ছে, যেগুলো সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে শিক্ষা গ্রহণ করছে। যেমন বড় আকারে করোনা পরীক্ষার সময় এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে।
এবার এমন এক অ্যাপ আসতে চলেছে, যেটিকে প্রশ্ন করলে কারও সংক্রমণ আছে কি না, তা চটজলদি জানিয়ে দেবে। এমন দ্রুত অডিও টেস্ট মূল পরীক্ষার বিকল্প হতে না পারলেও ৯০ শতাংশ পর্যন্ত নিখুঁত হতে পারে। বর্তমানে যত বেশি সম্ভব মানুষের কণ্ঠ ধারণ করে সেই সফটওয়্যার অনুশীলনের কাজ চলছে। অডিয়ারিং কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফ্লোরিয়ান আইবেন বলেন, ‘যেমন কাশি ও হাসির সময়ে ফুসফুসের ওপর কতটা চাপ পড়ে, তা পরিমাপ করা যায়। সিগনাল প্রসেসিং অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে আমরা সেটা সম্ভব করি। সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অনুশীলন দিতে পারি। করোনা পরীক্ষায় যাদের সংক্রমণ ধরা পড়েছে বা পড়েনি অথবা যাদের করোনার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাদের কণ্ঠ শুনে সফটওয়্যার শনাক্ত করতে পারবে।’
কৃত্রিম পদ্ধতিতে ফুসফুসের রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর বড় ঝুঁকি থাকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এমন প্রচেষ্টার কারণে মৃত্যুর হার যথেষ্ট বেশি।
মিউনিখের এক সফটওয়্যার কোম্পানি তাই এমন এক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সৃষ্টি করেছে, যার মাধ্যমে এমন রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ফুসফুসের ডিজিটাল মডেল তৈরি করে তাতে বাতাসের প্রবেশের হার নকল করা যায়। এভাবে সহনীয় চাপ নির্ণয় করে ভেন্টিলেটরের মাত্রা স্থির করা যায়।
এবেনবিল্ড কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. ইয়োনাস বিলার বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত ডাক্তার ফুসফুসের ভেতরে উঁকি মারতে পারেন না। তিনি শুধু দেখতে পান, ভেন্টিলেটর উইন্ডপাইপের উপর কতটা চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের প্রযুক্তির সাহায্যে তিনি প্রথম বার ফুসফুসের মধ্যে উঁকি মেরে দেখতে পারবেন, বাতাস প্রবেশ করে ঠিক কোথায় চাপ সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, ডিজিটাল টুলের মাধ্যমে তিনি রোগীর কোনো ক্ষতি না করে চিকিৎসার আগেই তার ফুসফুসের উপর ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে নানা রকম পরীক্ষা করতে পারেন।’
চিকিৎসার পণ্য হিসেবে এই সফটওয়্যারের অনুমোদন পাওয়া আপাতত কোম্পানির আগামীর লক্ষ্য। দুই বছর পর এই টুল ইউরোপের বাজারে আসতে পারে। ততদিনে হয়তো করোনা সংকট ইতিহাস হয়ে উঠবে।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ