প্রতিবছর ২৮ মে পালিত হয় বিশ্ব ব্লাড ক্যানসার দিবস। ২০২৫ সালে এই দিবসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ব্লাড ক্যান্সার বা রক্তের ক্যানসার নিয়ে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন নতুন অগ্রগতি মানুষের জীবনে নতুন আশা নিয়ে এসেছে।
রক্ত ক্যানসার বিভিন্ন প্রকারের হলেও তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা এবং মায়েলোমা। এই ক্যানসারগুলো মূলত রক্তের কোষ বা ইমিউন সিস্টেমের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকৃতির ফলাফল।
ব্লাড ক্যানসার: পরিচিতি ও প্রভাব
রক্ত ক্যানসার হলো এমন এক ধরনের ক্যানসার যা রক্তের সাদা রক্তকণিকা, রক্তের প্লাজমা কোষ বা হাড়ের মজ্জায় (বোন ম্যারো) শুরু হয়। সাধারণত, এই রোগ ধীরে ধীরে বা কখনো দ্রুত শারীরিক ক্ষমতা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে। ব্লাড ক্যান্সারের উপসর্গ যেমন অতিরিক্ত ক্লান্তি, জ্বর, রক্তক্ষরণ, ওজন কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব, অস্বাভাবিক পেশী ব্যথা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়, যা দ্রুত সঠিক চিকিৎসা না পেলে প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ব্লাড ক্যান্সারের বাস্তবতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও বিভিন্ন ক্যানসার গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানায়, প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যথাযথ চিকিৎসা পৌঁছানো এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশেও প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন রোগী ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা হল চিকিৎসাবিজ্ঞানে জেনেটিক গবেষণা, টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি’র মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সচেতনতা ও প্রাথমিক নির্ণয়ের গুরুত্ব
ব্লাড ক্যানসারের বিরুদ্ধে সফলতার মূল চাবিকাঠি হলো প্রাথমিক নির্ণয় ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ। অধিকাংশ রোগী রোগের প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করানোর কারণে দেরিতে চিকিৎসার সুযোগ পান, যা রোগ নিরাময়ে বাধা সৃষ্টি করে। তাই বিশ্ব ব্লাড ক্যানসার দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষকে এই রোগ সম্পর্কে সচেতন করা, যাতে তারা সঠিক লক্ষণ বুঝতে পারে ও দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী নানা প্রতিষ্ঠান ব্লাড ক্যানসারের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। যেমন- ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকিপূর্ণ কারণ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ক্যান্সার স্ক্রিনিং ক্যাম্প, ফ্রি মেডিকেল চেকআপ এবং রোগীদের মানসিক সহযোগিতা প্রদান।
বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়
বাংলাদেশে ব্লাড ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী সহ বড় শহরগুলোতে এখন অনেক আধুনিক ক্যানসার হসপিটাল ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তবে সারা দেশে চিকিৎসা সুবিধার অভাব এবং উচ্চমূল্যের ওষুধের কারণে অনেক রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও এনজিও সংস্থাগুলোর উচিত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়া। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ কমানো, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা রক্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
গবেষণা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
বর্তমান কালে ব্লাড ক্যানসার গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষত জেনেটিক ও মলিকুলার বায়োলজির উন্নত প্রযুক্তি রোগ নির্ণয়কে অনেক সহজ ও দ্রুততর করেছে। নতুন ধরনের টার্গেটেড ওষুধ ও ইমিউনোথেরাপি রোগীদের জীবনের গুণগত মান উন্নত করেছে। সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন বা হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন রোগ নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিশ্ব ব্লাড ক্যানসার দিবস-২০২৫ এ আমরা আশা করি, বিজ্ঞান ও সমাজের একতায় এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই আরও শক্তিশালী হবে।
আমাদের করণীয়
১. সচেতন হোন: ব্লাড ক্যানসারের লক্ষণ ও ঝুঁকির ব্যাপারে অবহিত থাকুন।
২. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন: বিশেষ করে যারা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণিতে পড়েন।
৩. সঠিক চিকিৎসা নিন: সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
৪. পরিবার ও সমাজে প্রচার করুন: সচেতনতা ছড়িয়ে দিন।
৫. সরকার ও এনজিও-র সহায়তা নিন: রোগীদের জন্য ফ্রি বা সাশ্রয়ী চিকিৎসা খোঁজার চেষ্টা করুন।
মোকাবিলায় সচেতন হই
বিশ্ব ব্লাড ক্যানসার দিবস ২০২৫ শুধুমাত্র একটি দিবস নয়, এটি একটি আহ্বান সারা বিশ্ববাসীর কাছে- যাতে আমরা ব্লাড ক্যান্সার মোকাবিলায় একত্রিত হই, সচেতন হই, এবং রোগীদের পাশে দাঁড়াই। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির বিকাশ এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা এই মারাত্মক রোগকে হারাতে পারব। আজকের ছোট সচেতনতা আগামীকালের বড় পরিবর্তনের সূচনা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রক্তরোগ বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ