বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

লো ব্লাড প্রেসার ও করণীয়

লো ব্লাড প্রেসার ও করণীয়

ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। মানবদেহে রক্তচাপের একটি স্বাভাবিক মাত্রা আছে। তার ওপর ভিত্তি করেই উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার ও নিম্ন রক্তচাপ বা লো ব্লাড প্রেসার পরিমাপ করা হয়। রক্তচাপ একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থাকে এবং তা দুই ধরনের হয়। উপরের মাপকে সিস্টলিক রক্তচাপ ও নিম্নের মাপকে ডায়োস্টোলিক রক্তচাপ বলা হয়। সাধারণত পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সিস্টলিক রক্তচাপ ১০০ থেকে ১৪০ মি. মি. মার্কারি এবং ডায়োস্টোলিক রক্তচাপ ৬০ থেকে ৯০ মি. মি. মার্কারি হয়ে থাকে। যদি কারও সিস্টলিক ১৪০ এর চেয়ে বেশি এবং ডায়োস্টোলিক ৯০ এর চেয়ে বেশি থাকে, তবে এই অবস্থাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার বলা হয়। আর যদি কারও সাধারণত রক্তচাপ সিস্টলিক ১০০ এবং ডায়াস্টোলিক ৬০ এর নিচে থাকে, তবে এ অবস্থাকে নিম্ন রক্তচাপ বা লো ব্লাড প্রেসার বলা হয়ে থাকে। তবে ব্যক্তি ও বয়স ভেদে এ পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। অনেকে বলেন, আমার ‘লো প্রেসার’, সব সময় রক্তচাপ কম থাকে এবং নিম্ন রক্তচাপ বা লো ব্লাড প্রেসার নিয়ে অনেক মানুষই দুশ্চিন্তায় থাকেন। কিন্তু নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, তবে অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

কি কি কারণে হতে পারে : লো ব্লাড প্রেসার দুই রকমের হয়ে থাকে-(১) একিউট বা ক্ষণস্থায়ী এবং (২) ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি।

যে কারণে একিউট বা ক্ষণস্থায়ী লো প্রেসার হয়ে থাকে : পানিশূন্যতা দেখা দিলে যেমন অতিরিক্ত ঘাম, ডায়রিয়া বা অত্যধিক বমি হওয়া। এতে ডিহাইড্রেশন হয়ে লো ব্লাড প্রেসার হয়। লো ব্লাড প্রেসারের অন্যতম কারণ হলো ডিহাইড্রেশন। * অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ যেমন- রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত বা দুর্ঘটনার ফলে রক্তপাত ঘটলে। * অপুষ্টিজনিত কারণে লো ব্লাড প্রেসার দেখা দিতে পারে। * গর্ভবতী মায়েদের গর্ভের প্রথম ছয় মাস হরমোনের প্রভাবে লো প্রেসার হতে পারে। * কিছু কিছু ওষুধ যেমন উচ্চ রক্তচাপের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ ব্যবহারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে লো ব্লাড প্রেসার হতে পারে। * বিভিন্ন ওষুধ, কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্য এবং সংক্রমণজনিত কারণে এলার্জিক রিএকশন হয়ে এনাফাইলেকটিক সক হলে লো প্রেসার হতে পারে। * ভ্যাসোভ্যাগাল সিঙ্কোপ নামে একটি রোগ আছে, তাতেও লো প্রেসার হতে পারে। কেউ রক্ত দেখলে বা হঠাৎ করে কোনো কারণে ভয় পেলে রক্তনালি অস্বাভাবিক বেশি রকম প্রসারিত হয়ে অনেক লো প্রেসার হতে পারে। তখন রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।

শরীরে পানিশূন্যতা ও ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতার কারণে নিম্ন রক্তচাপ হলে শুধু খাবার স্যালাইন মুখে খেলেই প্রেসার স্বাভাবিক হতে পারে। প্রয়োজনে শিরায় স্যালাইন বা এ জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়

- অধ্যাপক ডা. বি এম আবদুল্লাহ

যে কারণে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি লো প্রেসার হয়ে থাকে : অনেকদিন অপুষ্টিজনিত যেমন ঠিকমতো বা সময়মতো না খেলে বা খেতে না পারলে। * হজমে দুর্বলতা থাকলে পুষ্টিহীনতা ঘটে, ফলে লো ব্লাড প্রেসার দেখা দিতে পারে। * রক্তশূন্যতা, হরমোনজনিত সমস্যা যেমন হাইপোপিটুইটারিজম, অ্যাড্রিনাল হরমোন স্বল্পতার ফলে এডিসনস ডিজিজে লো ব্লাড প্রেসার হয়। * কোনো কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে সুগার কমে অথবা অতিরিক্ত সুগার হলেও লোভ ব্লাড প্রেসার দেখা দিতে পারে। * গুরুতর জীবাণু সংক্রমণের ফলে যেমন সেপটিক শক এবং স্নায়বিক দুর্বলতার কারণেও লো প্রেসার হয়। * বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ যেমন নাড়ির গতি কম হওয়া, হার্ট ফেইলুর, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন এবং হার্টের ভাল্বের সমস্যা দেখা দিলেও লো প্রেসার হতে পারে।

লো ব্লাড প্রেসার এর লক্ষণ বা শারীরিক উপসর্গ : মাথা ঘোরানো বা মাথা হালকা অনুভূত হওয়া, মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ক্লান্তি, দুর্বলতা, চোখে অন্ধকার দেখা, চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। অনেক সময় লো প্রেসারের কারণে মাথায় রক্ত ঠিকমতো পৌঁছায় না। ফলে অজ্ঞান হতে পারে, তখন পরিস্থিতি হয়ে যায় প্রাণঘাতী। * বসা বা শোয়া থেকে হঠাৎ ওঠে দাঁড়ালে মাথা ঘোরা বা ভারসাম্যহীনতা। * শারীরিক দুর্বলতা, মানসিক অবসাদগ্রস্ততা, কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা। * ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া বা হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া। * বেশি তৃষ্ণা অনুভূত হওয়া।

লো প্রেসারের কি কি চিকিৎসা দিতে হবে : লো প্রেসার বা নিম্ন্ন রক্তচাপের কারণ ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। * হঠাৎ ব্লাড প্রেসার বেশি কমে গিয়ে যদি শকের উপসর্গ দেখা দেয় এবং রোগীর জ্ঞান থাকে তাহলে পা দুটো মাথার থেকে উঁচু করে রেখে সমতল জায়গায় শুইয়ে দিতে হবে। * শরীরে পানিশূন্যতা ও ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতার কারণে নিম্ন রক্তচাপ হলে শুধু খাবার স্যালাইন মুখে খেলেই প্রেসার স্বাভাবিক হতে পারে। প্রয়োজনে শিরায় স্যালাইন বা এ জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। * খাবার স্যালাইন সবচেয়ে উপযোগী এবং তাৎক্ষণিক ফলদায়ক। সঙ্গে কার্বোহাইড্রেট এবং গ্লুকোজ খেলেও ভালো উপকার পাওয়া যায়। * রক্তক্ষরণ হলে প্রয়োজন অনুযায়ী রক্ত সঞ্চালন বা ব্লাড ট্রান্সফিউশন করতে হবে। * যেসব ওষুধে রক্তচাপ কমায় বা লো প্রেসার হতে পারে সেসব ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। * যাদের দীর্ঘমেয়াদি নিম্ন রক্তচাপ আছে তাদের অবশ্যই কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ ধরনের অবস্থায় চিকিৎসক নিম্ন রক্তচাপের কারণ শনাক্ত করে ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন।

লো নাকি হাই প্রেসার- কোনটি বেশি খারাপ?

দুটোই খারাপ, তবে যখন প্রশ্ন করা হয় কোনটি বেশি খারাপ? নিঃসন্দেহে লো প্রেসার বা নিম্ন রক্তচাপ বেশি খারাপ। কারণ হঠাৎ প্রেসার কমে গেলে বা কোনো কারণে প্রেসার কমে গেলে তাৎক্ষণিক শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে। এ জন্যই ডায়রিয়ায় পানিশূন্যতা রোধে শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয়। তবে উচ্চ রক্তচাপও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। উচ্চ রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।

লো ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ : নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার, শাকসবজি, ফলমূল গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত। বেশি সময় খালি পেটে থাকলে রক্তচাপ আরও কমে যেতে পারে। লো ব্লাড প্রেসারের রোগীদের জন্য সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করা অত্যন্ত জরুরি। খাবারের সঙ্গে পাতে একটু লবণ বেশি খেলে ভালো হয়। এমনকি পানি, ফলমূল খাবার সময়েও একটু লবণ মিশিয়ে খাওয়া উচিত। * ওষুধ ব্যবহারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। লো প্রেসারকে এককভাবে কোনো রোগ মনে করার কারণ নেই। যে কারণে লো প্রেসার হয়, চিকিৎস-কের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর