বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

রেশমের সুদিন ফেরার অপেক্ষা

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রেশমের সুদিন ফেরার অপেক্ষা

‘বনের পাতা খেয়ে পোকা, ঢেলে দেয় সোনার টাকা’- বাংলার কৃষকদের মধ্যে প্রচলিত এ প্রবাদটি রেশমগুটিকে নিয়ে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেশমের সুনামটা দেশজুড়েই। বলা যেতে পারে, আমের মতো রেশমের সুনাম ছিল সারা দেশে। মাঝে খেই হারিয়ে ফেলা রেশম আবার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। 

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় অবিভক্ত বাংলায় রেশমশিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ করে। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা এবং ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ বেঙ্গল সিল্কের প্রধান উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পায়। সেই রেশমই কালে কালে রাজশাহীর প্রধান পরিচয় হয়ে ওঠে ‘সিল্কসিটি’। দুই দশক আগে ২০০২ সালে তৎকালীন জোট সরকার বন্ধ করে দেয় রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী রেশম কারখানা। টানা ১৬ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সালে আবারও চালু হয় কারখানাটি। রেশমের সুদিন ফেরাতে নেওয়া হয় ১৫৩ কোটি টাকার চার প্রকল্প। রাজশাহীতে রেশমের ঐতিহ্যের কারণে ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতিও মেলে। এতে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের সুদিনের অপেক্ষায় বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড।

রেশম বোর্ডের ভাষ্যমতে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর রেশম কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে রেশম চাষিদের উৎপাদিত রেশমগুটি থেকে কারখানার সামনের রেশম ডিসপ্লেতে মিলছে খাঁটি রেশম পণ্য যেমন- প্রিন্টেড শাড়ি, টু-পিস, থান কাপড়, ওড়না, স্কার্ফ, টাই ইত্যাদি।

বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী জানান, রাজশাহী সিল্কের জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এর চাহিদা আবার বেড়েছে। রেশম বোর্ডের ১১টি নার্সারি আছে। সেখানে সুতা উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। এতে করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে সুতা বাইরে রপ্তানি করা যাবে। পুকুরপাড়ে রেশম চাষের ব্যবস্থা করতে পারলে পরিত্যক্ত পোকাগুলো মাছের খাবার হতে পারে। এই খাতে অন্তত ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট জার্মপ্লাজম ব্যাংকে তুঁত জাতের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮৩ ও রেশমকীট জাতের সংখ্যা ৮৫ হতে ১১৩ তে উন্নীত করেছে। ২৭টি উচ্চ ফলনশীল রেশমকীটের জাত উদ্ভাবনের ফলে প্রতি ১০০টি রোগমুক্ত ডিমে ৭০ থেকে ৭৫ কেজি রেশমগুটি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল ১৭টি তুঁতজাত উদ্ভাবনের ফলে বছরে হেক্টরপ্রতি তুঁত পাতার উৎপাদন ৪০ থেকে ৪৭ মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। স্বল্প সময় ও অল্প ব্যয়ে অধিক মানসম্পন্ন কাঁচা রেশম উৎপাদনের জন্য মাল্টি অ্যান্ড রিয়ারিং ও পরীক্ষণ যন্ত্রপাতি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে মানসম্পন্ন কাঁচা রেশম সুতা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রধান ফসল হিসেবে চাষিদের তুঁত চাষ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এখন বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত জায়গায় বেশির ভাগ তুঁত চাষ হয়। রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে তুঁত চাষকে জনপ্রিয় করতে সাথী ফসল প্রবর্তন করা হয়েছে। চাষিরা এভাবে চাষ করলে লাভবান হবেন।

রেশম উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বন্ধ ঘোষণার সময় রেশম কারখানায় মোট ৬৩টি লুম ছিল। এগুলোর মধ্যে উৎপাদন চলত পুরনো ৩৫টি লুমে। নতুন ২৮টি লুম চালুর আগেই কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধের আগে কারখানাটি বছরে ১ লাখ ৬ হাজার মিটার রেশম কাপড় উৎপাদন করত। কারখানায় ৬৩টি লুম চালু করা গেলে বছরে কাপড় উৎপাদিত হবে ২ লাখ ৮৭ হাজার মিটার। কারখানায় দৈনিক মজুরিভিত্তিক ৪১ জন কর্মচারী কাজ করছেন। তারা প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ গজ কাপড় উৎপাদন করছেন। তাদের উৎপাদিত কাপড় কারখানার বিক্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক ড. আহসান মান্নান বলেন, রেশম শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ও জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বর্তমানে গবেষণা কার্যক্রমসহ রেশম সম্প্রসারণে প্রায় ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীসহ সারা দেশে চারটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে রেশম চাষ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে পার্বত্য জেলাগুলোতে আদিবাসী ও আদিবাসী নয়- এমন হতদরিদ্র ১০ হাজার ব্যক্তির কর্মসংস্থান অন্যতম। এ ছাড়া পার্বত্য জেলাগুলোতে রেশম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১২ মেট্রিক টন কাঁচা রেশমের নতুন উৎস সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলমান। বৃহত্তর রংপুর এলাকায় ১৫ হাজার হতদরিদ্র ও ভূমিহীন বিশেষ করে নারীদের রেশম চাষে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর আরেকটি প্রকল্প চলমান। এতে রেশমের বিভিন্ন বিষয়ে ২ হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে রেশম চাষের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ মেট্রিক টন কাঁচা রেশমের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব যা দেশীয় চাহিদা পূরণ করবে। তিনি জানান, রেশমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফার্মিং পদ্ধতিতে রেশম চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে।  দেশে তুঁতচাষ বৃদ্ধিসহ রেশম গুটি ও সুতা উৎপাদন কাজে নিয়োজিত তুঁত চাষি ও সংশ্লিষ্টদের উপযুক্ত সহায়তা প্রদান হচ্ছে। এর ফলে রেশম পণ্য বাজারজাতকরণের সুযোগ ও নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর