পদ্মা সেতুর পরেই অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় নতুন চমক আনছে বঙ্গবন্ধু টানেল। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনের সম্ভাবনাকেও ছাড়িয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে নির্মিতব্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই টানেল বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও জীবনমান উন্নয়ন, নগরায়ণ ও সমৃদ্ধির পথে যুক্ত করছে নতুন পালক।
আগামী পাঁচ মাসের মধ্যেই নির্মাণ কাজ সম্পাদন করে উদ্বোধনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলছে টানেলটি। তবে একে ঘিরে এখনই খুলছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দরজা-জানালা। নতুন শিল্পায়ন উদ্যোগ চলছে অবিরত। বিনিয়োগ আকর্ষণে বেড়েই চলেছে আশপাশের ভূমির দাম। টানেলের দুই প্রান্তের ভূমি মানেই যেন হীরক খন্ড। বাড়ছে কাজের সুযোগও।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং নির্মাণ কাজের শুভ সূচনা করেন। সেই থেকেই এই প্রকল্পকে ঘিরে কর্ণফুলীর দুই পাড়ের মানুষের জীবনমান বদলে যাওয়ার এক নবতর প্রক্রিয়া শুরু বলে জানালেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।তিনি জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী গৃহীত দেশের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার সিংহভাগ আছে চট্টগ্রামকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু টানেলটির মধ্য দিয়ে মেগা প্রকল্পগুলোর সুবিধা সংযোগ হয়ে সমগ্র চট্টগ্রামের জীবনমান বদলে যাবে।’ মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘টানেলটি উদ্বোধন হলে প্রায় ৩৩ হাজার একর ভূমির ওপর মিরসরাইয়ে নির্মাণাধীন স্পেশাল ইকোনমিক জোন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, চায়না ইপিজেড ও মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর সংযোগ ও কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন সম্ভাবনা বেশ জোরালো হবে। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, বাড়বে জীবনযাত্রার মান।’ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর ওপর এই টানেল জীবন যাত্রা ও যোগাযোগ বিস্তৃতির ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে এটি। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এর অবদান হবে উল্লেখ করার মতো।’ সদ্য অনুমোদিত জাতীয় বাজেটটি ঘোষণার পরপরই গেল মাসের শেষান্তে এই প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে ড. মইনুল জাতীয় স্বার্থেই টানেল প্রকল্পটি যথাসময়ে গতিশীল বাস্তবায়ন ও নিকটবর্তী এলাকার জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকারের বিশেষ বরাদ্দও দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘টানেলটির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শিল্পায়ন ও এশিয়ান হাইওয়ের সংযোগ এই টানেলটি বহুমুখী অগ্রগতির সেতুবন্ধন ঘটাবে।’ চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম জানান, ‘বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে এরই মধ্যে বিনিয়োগের নব উদ্যম তৎপরতা শুরু হয়েছে। টানেলটি ‘টু ইন সিটি’ চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রাম শহর অংশ ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলকে সংযুক্ত করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন শিল্প সম্ভাবনা। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে একের পর এক। শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনেও এটি আনবে নতুন যুগ। দেশের অর্থনীতির ‘গেটওয়ে’ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর একদিকে, অন্যদিকে ডিপ সি পোর্ট সংযুক্ত হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আনবে এটি। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত জনজীবনে সুফল বিস্তৃত হবে নিঃসন্দেহে।’ চিটাগাং চেম্বার সভাপতি পদ্মা সেতু প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে আরও বলেন, ‘কর্ণফুলী টানেলের যোগাযোগ বিস্তৃতির শতভাগ সফলতা তখনই আসবে, যদি এর জংশনে ট্রাফিক সিস্টেম আধুনিকায়ন হয় এবং মোটরসাইকেল চলাচল, হেঁটে প্রবেশ ও সেলফিবাজি বন্ধ করা হয়।’ একই সঙ্গে লিংক রোডের পরিসর বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন মাহবুবুল আলম। করোনায় লকডাউনের কারণে স্বাভাবিক গতিতে কাজ না হওয়া ও টানেলটির কিছু নির্মাণ সরঞ্জাম চীনের সাংহাই থেকে সংগ্রহে বিলম্ব হওয়ায় নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য সময় ডিসেম্বর ছাড়িয়ে আগামী জুন পর্যন্ত বাড়ার একটি প্রক্রিয়া প্রস্তাব উঠেছে। তবে এটি এখনো নিশ্চিত হয়নি বলে জানান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।