আরব বিশ্বের প্রথম নারী পাইলট ছিলেন লতফিয়া এলনাদি। মিসরের এই নারী ১৯৩৩ সালে বিমান নিয়ে আকাশে উড়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। ২৫ বছর বয়সে কায়রোর বাইরে এক ছোট্ট এয়ারস্ট্রিপ থেকে একটি জিপসি মথ প্লেন নিয়ে প্রথম যখন তিনি একাকী আকাশে উড়লেন, সেটি ছিল এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
সেই দিনের অনুভূতির কথা তিনি জানিয়েছিলেন পরে এক সাক্ষাৎকারে। তিনি জানান, ‘প্রথম যখন আমি বিমান নিয়ে আকাশে উড়লাম, তখন বিমানটিকে বেশ হালকা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আর কেউ নেই আমার সাথে। আমার মনে হচ্ছিল, পুরো বিশ্ব যেন আমার। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন আমি সবসময় দেখেছি, সেই স্বাধীনতা যেন এখন আমার হাতের মুঠোয়।’
এই ঘটনা ছিল মিসর এবং আরব বিশ্বের জন্য উদযাপন করার মতো এক মুহূর্ত। প্রথম আরব নারীর বিমান চালানোর খবর মিসরের সব সংবাদপত্র, সব ম্যাগাজিনে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। রাতারাতি তিনি পেয়েছিলেন তারকা খ্যাতি।
জানা গেছে, লতফিয়া এলনাদির জন্ম হয়েছিল মিসরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি বিমান চালানোর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মিসরে বিমান পরিবহন তখন মাত্র শুরু হয়েছে। একটি জাতীয় বিমানবন্দর পর্যন্ত নেই। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনী আরএএফের কয়েকটি এয়ারফিল্ড ছিল মিসরে। ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজ কায়রো হতে ইরাকের বসরা নগরীতে তাদের প্রথম নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু করে।
এটি ছিল আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের এক স্বর্ণযুগ। তখন চার্লস লিন্ডবার্গ, অ্যামি জনসন এবং অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের মতো পাইলটরা রীতিমত তারকা। অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট তার কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রসকান্ট্রি বিমান পরিচালনায় এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছেন। এই নারী পাইলটদের এসব অ্যাডভেঞ্চার লতফিয়ার মধ্যে নতুন স্বপ্নের জন্ম দিলো।
লতফিয়ার এই পাইলট হওয়ার সময়টাতে আলমাজা নামে আমাদের খুব ছোট একটা বিমানবন্দর ছিল। এই বিমানবন্দরটি এখনো আছে। এটা আসলে কাঠের একটা ছোট্ট কুটিরের মতো। আর সেখানে পাইলটদের বিশ্রাম নেয়ার জন্য দুটি বেঞ্চ ছিল। লতফিয়া আরবি ছাড়াও ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষা বলতে পারতেন। সেখানে যেসব পাইলট এবং প্রশিক্ষক কাজ করতো, লতফিয়া তাদের কাজে সাহায্য করতেন। কাজ করে যা আয় করতেন, সেটা দিয়ে তার বিমান চালনা প্রশিক্ষণের খরচ জোগাতেন। লতফিয়া আমাকে জানিয়েছিলেন, এক ঘণ্টা আকাশে উড়ার খরচ ছিল ৫০০ মিসরীয় পাউণ্ড। তখন এটা কিন্তু অনেক টাকা।
পাইলট হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এমন প্রায় ৩০ জন পুরুষের মধ্যে লতফিয়া ছিলেন একমাত্র নারী। কায়রো ছিল তখন বেশ কসমোপলিটন এক নগরী। সনাতনী ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে অনেক নারী তখন বিভিন্ন পেশায় কাজ শুরু করেছেন।
বেশিরভাগ ফ্লাইট ইনস্ট্রাকটর ছিলেন ইংরেজ। লতফিয়া ছিলেন ড্যান ক্যারল নামে এক লোকের তত্ত্বাবধানে। লতফিয়া জানিয়েছিলেন, ড্যান ক্যারল ছিলেন বেশ কড়া, তবে ভালো লোক।
লতফিয়া এলনাদি তার জীবনে কখনো পেশাদার পাইলট হননি। তার কাছে এটি ছিল কেবলই নেশা। কিন্তু পাইলট হিসেবে লাইসেন্স পাওয়ার পাঁচ বছর পরেই তার এই বৈমানিক জীবন এক দুর্ঘটনায় থমকে যায়। বাড়িতে এই দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন।
১৯৬০-এর দশকে লতফিয়া এলনাদি সুইটজারল্যান্ডে চলে যান তার মেরুদণ্ডের চিকিৎসার জন্য। একটি দুর্ঘটনার কারণে যে তার বৈমানিক জীবনের ইতি টানতে হয়েছিল, সেটি নিয়ে তাহলে তার মধ্যে কোনো দুঃখবোধ ছিল না।
২০০২ সালে ৯৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। লতফিয়া এলনাদির পথ অনুসরণ করে আরব বিশ্বে পরে আরো অনেক নারী পাইলট হয়েছেন, মেয়েদের পাইলট হিসেবে কাজ করা এখন একেবারেই একটা সাধারণ চিত্র। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক