যে তালেবানকে ২০০১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছে, সেই তালেবানের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র আবার সন্ধি করেছে। আর সেই পটভূমিতেই আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের জীবন গেছে, লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তিতে তালেবান অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা আফগানিস্তানকে আর এমন কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ঘাঁটি হতে দেবে না, যারা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
কিন্তু চুক্তির পর আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্যরা বিদায় নেয়া শুরু করার পর থেকেই তালেবান খুব দ্রুত আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে বিভিন্ন এলাকা দখল করা শুরু করে। অন্যদিকে আফগান সেনাবাহিনীকে এখন কাবুলে এক নাজুক সরকারকে রক্ষায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
তালেবান আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা একটি জাতীয় শান্তি আলোচনায় অংশ নেবে। কিন্তু অনেকের আশংকা, আফগানিস্তানে শান্তি দূরে থাক, দেশটি বরং এখন একটা চরম গৃহযুদ্ধের দিকেই যাচ্ছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহারের জন্য একটা প্রতীকী তারিখ নির্ধারণ করে ফেলেছেন-সেটি হচ্ছে ১১ সেপ্টেম্বর, ঠিক যে দিনটিতে বিশ বছর আগে আল কায়েদা যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল।
জো বাইডেন হচ্ছেন চতুর্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যাকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে? এই যুদ্ধ এত দীর্ঘ হলো কেন?
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে যে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালানো হয়, তাতে প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হয়। এই হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র এই সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য দায়ী করেছিল আল কায়েদা এবং এর নেতা ওসামা বিন লাদেনকে।
ওসামা বিন লাদেন তখন আফগানিস্তানে তালেবানের আশ্রয়ে ছিলেন। তালেবান ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকার যখন ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। তারা বেশ দ্রুতই আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে তালেবানকে অপসারণ করে। আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সেখান থেকে যেন আর কোন সন্ত্রাসবাদী হুমকি তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিরা পালিয়ে গিয়ে আবার নতুন করে সংগঠিত হয়।
আফগানিস্তানের এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল নেটো জোটের মিত্র দেশগুলো। তালেবানের পতনের পর ২০০৪ সালে সেখানে এক নতুন আফগান সরকার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু তালেবানের সহিংস হামলা অব্যাহত থাকে।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা সংখ্যা বাড়িয়ে তালেবানকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হন। কিন্তু এই সাফল্য বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি।
২০১৪ সাল ছিল আফগানিস্তানের লড়াইয়ে ২০০১ সালের পর সবচেয়ে রক্তাক্ত একটি বছর। নেটোর আন্তর্জাতিক বাহিনী সেবছর আফগানিস্তানে তাদের সম্মুখ লড়াইয়ের সমাপ্তি টানে। আফগানিস্তানের নিরাপত্তার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় আফগান সেনাবাহিনীর হাতে।
কিন্তু এটি যেন তালেবানকে সুযোগ করে দেয় আফগানিস্তানে নতুন করে বিভিন্ন এলাকা দখলের। তাদের মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চার হয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়, তবে এই আলোচনায় আফগান সরকারের কোনো ভূমিকাই ছিল না। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে কাতারে একটা চুক্তি হয়, যার অধীনে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহারে রাজী হয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানের মধ্যে এই চুক্তি সত্ত্বেও তালেবানের হামলা বন্ধ হয়নি। তালেবান এবার তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু করে আফগান বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকদের। তারা গুপ্তহত্যা শুরু করে। তালেবানের দখলে আসা এলাকা আরও সম্প্রসারিত হতে থাকে।
এই যুদ্ধের কী মূল্য দিতে হয়েছে
এই যুদ্ধে কত মানুষের প্রাণ গেছে, তা সঠিকভাবে নিরূপন করা কঠিন। পশ্চিমা নেটো জোটের কত সৈন্য মারা গেছে, অনেক ভালোভাবে তার হিসাব রাখা হয়েছে। কিন্তু তালেবান কিংবা আফগান বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব সেভাবে রাখা হয়নি।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে যে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬৯ হাজার সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। অন্যদিকে আফগান বেসামরিক মানুষ মারা গেছে ৫১ হাজার। নিহত হয়েছে প্রায় একই সংখ্যক জঙ্গি।
২০০১ সালের পর হতে নেটোর নেতৃত্বাধীন জোটের সাড়ে তিন হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়েছে। এদের দুই তৃতীয়াংশই মার্কিন সেনা। বিশ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা এই যুদ্ধে আহত হয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাবে, আফগানিস্তানের যে পরিমান মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, তা বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ।
২০১২ সাল হতে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে এবং আর ফিরে যেতে পারেনি। এরা হয় নিজ দেশেরই অন্য কোন অঞ্চলে থাকছে অথবা প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এই গবেষণায় আফগান যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কী পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে, তার হিসাবও দেয়া হয়েছে।
যুদ্ধ, সামরিক সহায়তা, পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠন-সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সাল পর্যন্ত খরচ করেছে ৯৭৮ বিলিয়ন ডলার ( ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার)।
এরপর কী ঘটতে পারে
যে প্রশ্নটা সবার আগে আসে, তা হলো, তালেবান কী আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসবে? প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, তার বিশ্বাস জঙ্গিরা কাবুলের সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাবে না।
কিন্তু গত জুন মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা সংস্থার পর্যালোচনায় বলা হয়েছিল, বিদেশি সৈন্য চলে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই কাবুলের সরকার পড়ে যেতে পারে।
বিবিসি এবং অন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আগস্ট মাস নাগাদ তালেবান এখন প্রায় অর্ধেক আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করছে।
তারা যতটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বলে দাবি করে, তা আফগান সরকার মানতে চায় না। কয়েকটি নগরীতে তীব্র লড়াই অব্যাহত আছে। এর মধ্যে কয়েকটির দখল জঙ্গিদের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা সাড়ে ছয়শো হতে এক হাজার সৈন্য রেখে দেবে মার্কিন দূতাবাস, কাবুল বিমান বন্দর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা পাহারা দেয়ার জন্য। তালেবান বলেছে, যদি কোনো মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে থেকে যায়, তাহলে তাদেরকে টার্গেট করা হবে।
আফগানিস্তান নিয়ে আরেকটি আশংকা হচ্ছে, দেশটি আবারও সন্ত্রাসবাদীদের লালন ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।
তালেবান নেতারা বলেছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তি পুরোপুরি মেনে চলবেন এবং আফগানিস্তানের মাটিকে যুক্তরাষ্ট্র অথবা তাদের মিত্র কোন দেশের বিরুদ্ধে হামলার জন্য ব্যবহার করতে দেবেন না।
কিন্তু অনেক বিশ্লেষক বলছেন, তালেবান এবং আল কায়েদাকে আসলে আলাদা করা যায় না। কারণ আল কায়েদার যোদ্ধারা তালেবানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং তাদের প্রশিক্ষণে কাজে জড়িত। এটাও মনে রাখা দরকার যে, তালেবান কোন ঐক্যবদ্ধ এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত শক্তি নয়। কিছু তালেবান নেতা হয়তো পশ্চিমা দেশগুলোকে ঘাঁটাতে চান না, কিন্তু কট্টরপন্থীরা আল কায়েদার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে রাজী নাও হতে পারে।
আর আল কায়েদা এখন কতটা শক্তিশালী এবং তারা আবার তাদের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারবে কিনা-সেটাও স্পষ্ট নয়।
এরপর আছে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের আঞ্চলিক শাখা-আইএসকেপি (খোরাসান প্রদেশ)-যাদের সঙ্গে তালেবানের দ্বন্দ্ব আছে।
আল কায়েদার মতোই এই আইএসকেপিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে, কিন্তু বিদেশি সৈন্য চলে আসার পর এরা নতুন করে সংগঠিত হতে পারে।
এই গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা হয়তো কয়েকশো হতে দু হাজার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু গ্রুপটি কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের কিছু এলাকায় তাদের ভিত্তি তৈরির চেষ্টা করতে পারে। এট তখন এক গুরুতর আঞ্চলিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন