গণভোট ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল সে সময় শেষ হচ্ছে আজ। সময়সীমা শেষ হওয়ার আগের দিন গতকাল রাত পর্যন্তও বড় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ফলে পুরো বিষয়টি এখন সরকারের হাতে গিয়ে ঠেকেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আগেই বলা হয়েছে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারে, তবে সরকার নিজ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে।
জানা গেছে, আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এ বৈঠকে গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্য সময়, পদ্ধতি এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, ‘রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সিদ্ধান্ত আসতে না পারলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হওয়ার পর নিশ্চয়ই উপদেষ্টারা নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য আবারও বসবেন। এরপর দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
গণভোট অনুষ্ঠান ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এখন স্পষ্টতই পরস্পর বিপরীতমুখী। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী উভয় দলই পরস্পরকে দায়ী করছে এ বিষয়ে আলোচনার কোনো অগ্রগতি না হওয়ার জন্য। জামায়াতে ইসলামী বলছে, তারা বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেও দলটি তাতে সাড়া দেয়নি। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, আলোচনার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে আলোচনার পরিবেশ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে এই অচলাবস্থা কী দূর হবে না? সব পক্ষকে এক টেবিলে এনে কীভাবে হবে মীমাংসা?
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে যে কোনো আলোচনার জন্য ডাকলে আমরা যেতে রাজি আছি। অন্য কোনো দল ডাকলে এতে সাড়া দেওয়ার কিছুই নেই। কারণ তারা সরকারের কেউ নয়।’
জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে সমমনা আট দল কাল মঙ্গলবার রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশের ডাক দিয়েছে। জানা গেছে, ওই সমাবেশ থেকে তারা গণভোট বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। জোটের নেতারা বলছেন, ‘দেশের জনগণ গণভোট চায়। সরকার ও বড় দলগুলো যদি বাধা সৃষ্টি করে, তবে আমরা রাজপথে নামব।’
অন্যদিকে বিএনপি এখনো পাল্টা কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তারাও মাঠে নামবেন। বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। যদি দেখি সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তাহলে আমরা কঠোর অবস্থান নেব।’
জানা গেছে, সরকারের আহ্বানের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গত বৃহস্পতিবার ফোন করে আলোচনার জন্য আহ্বান জানান জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। বিএনপি মহাসচিব ওই সময় বলেন, তিনি দলের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয় জানাবেন। পরদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। নেতারা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘জামায়াত তো সরকার না। ফলে রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে তারা আমাদের ডাকতে পারে না। সুতরাং এ ইস্যুতে জামায়াতের আহ্বান “সঠিক পন্থা” নয়। তাই জামায়াতের আহ্বানে বিএনপি সাড়া দেবে না।’
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই সংকটের পেছনে সরকার ও ঐকমত্য কমিশন দায়ী। রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিন সময় দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। দায় এড়ানোর জন্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যর্থ প্রমাণ করতেই এটা করা হয়েছে। সাত মাস ধরে আমরা আলোচনা করেছি, কোথাও একমত হয়েছি, কোথাও একমত হতে পারিনি, সেটা সরকার জানে। দুই-একটা দল ছাড়া সবাই নির্বাচনের দিন গণভোটের পক্ষে আছি।’ তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ আছে।’
সরকারি পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই ছিল সরকারের পছন্দের পথ। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে সরকারই সিদ্ধান্ত দেবে গণভোট কীভাবে হবে এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কোন প্রক্রিয়ায় শুরু হবে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সাধারণ জনগণ এখন উদ্বিগ্ন। ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে ছাত্রসমাজ পর্যন্ত সবাই জানতে চায় গণভোট ও জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কী? নাগরিক সমাজের একাধিক প্রতিনিধি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে কোনো ঐক্য দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীর মিরপুরের স্কুলশিক্ষক শামসুদ্দিন ভুইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা শুধু শুনছি আলোচনার কথা, কিন্তু কাজের কিছুই হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের মধ্যে বসে সমাধান না করে, তাহলে আবারও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে।’
সূত্র বলছে, দলগুলোর সিদ্ধান্তের অপেক্ষার সঙ্গে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির প্রস্তুতিও এগিয়ে চলছে। উপদেষ্টা পরিষদের সর্বশেষ বৈঠকেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয় এবং আইন মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। সূত্র জানায়, কমিশনের দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ সরকার জারি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২৭০ দিনের সময়সীমার পরিবর্তে যত দিন লাগে, তত দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করার বিধান রাখা হতে পারে। একই সঙ্গে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া বাকি সব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ থাকতে পারে বলে জানা গেছে। সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিল পাস করবে।