রাজনীতি একটি বিজ্ঞান। আপ্তবাক্যটি অন্য সব রাজনীতিবিদের মতো আমিও শুনেছি কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে কখনো ভাবিনি। আর কীভাবেই বা ভাবব, যেখানে রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হুন্ডাগুন্ডা দলবাজি! টাকা ছাড়া যেখানে পদপদবি মেলে না। নমিনেশন ইলেকশনে বস্তা বস্তা টাকার খেলা এবং ড্রাম ভর্তি ঘি অঞ্জলি না দিলে যেখানে তকদির খোলে না সেখানে বিজ্ঞান নিয়ে ভাববার সময় কোথায়। বিজ্ঞান সম্পর্কে যদি আপনাকে চিন্তা করতে হয় তবে প্রথমেই বিজ্ঞানের সংজ্ঞা জানতে হবে। বিজ্ঞানের সহজসরল অর্থ হলো- বিশেষ জ্ঞান বা স্পেশাল নলেজ। অজানাকে জানার কৌতূহল, চলমান বিষয়বস্তু সম্পর্কে সন্দেহ এবং সেই সন্দেহ দূর করার জন্য অনুসন্ধান গবেষণা কিংবা চেষ্টা-তদবিরের নামই বিজ্ঞান। কাজেই কেউ যদি বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে প্রশ্ন করেন যে টাকা এলো কোত্থেকে! হুন্ডা কেন গুন্ডা বহন করবে। ঘি কেন নেতার পদতলে মালিশ করে নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে রাজনীতি করতে হবে। অথবা টিআর, কাবিখা, কাবিটা, ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাংকলুট, শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারির পর কেন রাজনীতি করার জন্য ওয়েস্টিন নামক পাঁচ তারকা হোটেলে পাপিয়ার খদ্দের হয়ে নৃত্যগীত-সুরা সাকির প্রতি অনুরাগ দেখাতে হবে! এসব প্রশ্ন যদি কোনো রাজনৈতিক কর্মী কোনো ক্ষমতাধর নেতার সামনে উচ্চারণ করেন তবে তার বত্রিশটি দাঁত আর আস্ত থাকবে না। প্রশ্নকর্তার গালের চামড়া-পিঠ ও পশ্চাদ্দেশের যে কী বেহাল করা হবে তা যারা বুঝতে পারেন তারা রাজনীতি করতে এসে সরে গেলেও বিজ্ঞান চর্চা তো দূরের কথা বরং বিজ্ঞান থেকে ৩৩ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করে ইয়া টাকা! ইয়া হুন্ডা। ইয়া গুন্ডা। ওয়া নেতা, কিয়্যা নেতা ইত্যাদি জিকিরফিকিরে টেম্পো স্ট্যান্ড গরুর হাট, ময়লার ভাগাড়, কাঁচাবাজার ইত্যাদি স্থানে রাজনীতির সৌধ নির্মাণ করে সমানতালে নৃত্যগীত আরম্ভ করে দেবে।
উল্লেখিত কারণে বাংলাদেশে যখন গত ১৪ মাস আগে হঠাৎ করে আমরা ম্যাটিকুলাস ডিজাইনের কথা শুনলাম, তখন এ কথা ভেবে ভারি আশ্চর্য হলাম যে রাজনীতিতে আবার অঙ্ক এলো
কোত্থেকে! আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞান যেখানে বিজ্ঞানের ব-এর কাছে যেতে দেয় না সেখানে শেখ হাসিনার পতনে বিজ্ঞানের জননী অঙ্ক ব্যবহার করে অর্থাৎ গণিতের সূত্র অনুযায়ী পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব সংঘটিত কীভাবে হলো? আমরা যখন বাংলার হাজার বছরের রাজনীতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ম্যাটিকুলাস ডিজাইনের কথা শুনলাম তখন সবাই ছি ছি ছ্যা ছ্যা রবে সেভাবে আওয়াজ করতে লাগলাম তা হুবহু পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের মহাবিজ্ঞানী গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ আবিষ্কারের বিরুদ্ধে রেগেমেগে অস্থির হাওয়ার সঙ্গে মিলে গেল।
বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রচলিত অনেক ধর্মের বিরোধ বহু শতাব্দীর পুরোনো এবং এই বিরোধে ধর্মান্ধরা আদিকালে এতটা নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে যে কোনো বিজ্ঞানী উন্মাদ না হলে সাধারণত ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করে না। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করার মধ্যেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, সুশাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্র গঠনের মূলমন্ত্র নিহিত থাকে বিধায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতর জাতিগোষ্ঠী রাজনীতির বিজ্ঞান চর্চা অবারিত করেছে। রাজনীতির বিজ্ঞান চর্চার কারণে মার্কিন মুলুকে একজন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মোহাম্মদ আলী ক্লে, অপরাহ উইনফ্রে, ডেপজেল ওয়াশিংটন, বারাক ওবামা কিংবা জোহরান মামদানির মতো মানবের জন্ম ও বিকাশ লাভ হয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশে রাজনীতিতে বিজ্ঞান চর্চা হলে কী ধরনের ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে, তা বোধ করি ২০২৫ সালে বাংলাদেশের আমজনতাকে খুলে বলতে হবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিজ্ঞান না থাকার কারণে আমরা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি বাকশাল, রক্ষীবাহিনী, কম্বল চোর, চিনি চোর নিয়ে প্রশ্ন করতে পারিনি। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রশ্ন করিনি হাঁ-না ভোট কাকে বলে- উহা কত প্রকার ও কী কী? একই সময়ে আমাদের মনে আসেনি মার্শাল ল প্রফ্লেসেশন কীভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কীভাবে ইনডেমনিটি পায় এবং ঘাতকরা কীভাবে দেশ থেকে পালায় এবং আবার ফিরে এসে রাজনৈতিক দল করে নিজেদের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে উল্লাস করে।
এরশাদ জমানায় আমরা বলতে পারিনি- কীভাবে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হলো এবং পার্লামেন্টে কীভাবে ৩০ সেট গয়নার অনুপ্রবেশ ঘটল। আমরা জিনাত মোশাররফ কিংবা মারিয়া মমতাজকে নিয়ে দুইটি তাজমহল নির্মাণ করা উচিত বলে কবিতা রচনার কথা ভেবেছি কিন্তু রাজপুরুষের ভ্রষ্টতা, চরিত্রহীনতা, দুর্নীতি অনিয়মের কথা চিন্তার আগেই ঠক ঠক করে কেঁপেছে। বিজ্ঞান বাদ দিয়ে আমরা আবেগ দিয়ে আমাদের রাজনীতিকে এতটা মহান করে তুলেছি যে নেতা-নেত্রীদের মানমর্যাদাকে দেবতুল্য করে তাদের জুতো স্যান্ডেল মাথায় তুলে নিজেদের যাবতীয় পাপকে পুণ্যে রূপান্তরের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অথচ সভ্য জাতির মতো আমরা যদি বিজ্ঞানের আলোকে রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করতাম তবে দেখতে পেতাম পৃথিবীর সব মহান রাজপুরুষ-রাজনীতিবিদ এবং রাজদরবারের প্রধান অলংকার এবং অপরিহার্য বিষয় ছিল বিজ্ঞান-দর্শন, শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতি। দরবারের একাংশে থাকতেন সেনাপতি-মন্ত্রী, আমির-ওমরাহ, ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রদূত। থাকতেন সভাকবি- সভাপণ্ডিত। মাঝেমধ্যে দরবার আলোকিত করতেন কাজী উল ফুজ্জাত অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রের বরেণ্য রাজনৈতিক অভিজাতবর্গ। দরবারে মাঝেমধ্যে সংগীত বিতর্ক নৃত্যগীতের আসর বসত আবার আমজনতা-ভিক্ষুক, সাহায্য প্রার্থী এবং মজলুমদের জন্য রাজদরবারকে অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলা হতো, সেখানে রাজার কাছে স্বয়ং রাজা, রাজপুত্র, রাজপরিবারের বিরুদ্ধে নালিশ জানানো যেত।
আমি ভেবে অবাক হই- আর্কিমিডিস, নিউটনের মতো বিজ্ঞানী কীভাবে রাজার আনুকূল্য পেয়েছিল। কলম্বাসের মতো নাবিক কীভাবে আমেরিকা বিজয়ের স্বপ্নের কথা বলার জন্য স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্দ এবং রানি ইসাবেলার রাজদরবারে প্রবেশ করেছিলেন। কীভাবে প্লেটো প্রাচীন গ্রিসের রাজনীতির ধর্ম গুরু হয়েছিলেন এবং অ্যারিস্টটল কীভাবে আলেকজান্ডারের শিক্ষক নিয়োজিত হয়েছিলেন। কেনো রোমান সম্রাট মহাজ্ঞানী সেনেফাকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন এবং রাজসিংহাসনে বসে মার্কাস অরলিয়াস কীভাবে সর্বকালের সেরা দার্শনিক এবং ঋষি হতে পেরেছিলেন। খলিফা হারুন আল রশিদ কেন বায়তুল হিকমা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং মহাকালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, রসায়নবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী জাবির আল হাইয়ানকে পারস্য থেকে বাগদাদে নিয়ে এসেছিলেন।
রাজনীতির সঙ্গে বিজ্ঞানের সূত্রেই চিত্রকর লিউনার্দো দা ভিঞ্চিকে রাজা তার সামরিক উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। ফলে আধুনিক হেলিকপ্টার ও কামানের ডিজাইন এগুলো আবিষ্কারের শত শত বছর আগে দ্য ভিঞ্চি মানবজাতির জন্য তৈরি করে যেতে পেরেছিলেন। মেডিকেল সায়েন্সের অ্যানাটমিতে লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চির অবদানকে আধুনিক পৃথিবীর এক্স-রে এমআরআই সিটি স্ক্যানও অতিক্রম করতে পারেনি।
তিনি তার জমানায় মানবদেহের পেশিসমূহ এত নিখুঁতভাবে অঙ্কন করে গেছেন যা ডাক্তাররা জটিল অপারেশনের সময় আজও ব্যবহার করে থাকেন। রাজা যখন আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার কিংবা নেপোলিয়নের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হন তখন যুদ্ধ শুরুর আগে যুদ্ধের ময়দান, প্রতিপক্ষের অস্ত্র, গোলাবারুদ মোকাবিলার জন্য অঙ্ক শাস্ত্রবিশারদ এবং জ্যামেতি ও ত্রিকোনোমিতি বিশারদদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করেন। যাত্রাপথের জন্য তার দরকার পড়ে ভূগোলবিদ, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, পুষ্টিবিদসহ নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। কিন্তু রাজা যখন বিজ্ঞানবিদ্বেষী হয়ে পড়েন তখন চাটুকার, তোষামদকারী, দুর্নীতিবাজ, নষ্ট-ভ্রষ্টরা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের মতো রাজনীতির ওপর চেপে বসে ঠিক যেভাবে মৃত প্রাণী বা উদ্ভিদের পচন ধরাতে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের দল উড়ে এসে জুড়ে বসে এবং আক্রান্ত প্রাণীদেহ অথবা উদ্ভিদকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তাদের মিশন শেষ করে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক