পৃথিবীকে শীতল রাখতে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনভূমির ভূমিকা অপরিসীম। গাছপালা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নিজেদের কাণ্ড ও শাখায় জমা রাখে—যা ‘কার্বন সিঙ্ক’ নামে পরিচিত। কিন্তু নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার একটি রেইনফরেস্ট এখন উল্টো কাজ করছে। এই বন এখন কার্বন শোষণের চেয়ে বেশি নিঃসরণ করছে, যা বিজ্ঞানীদের গভীর চিন্তায় ফেলেছে।
গত ১৫ অক্টোবর বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’–এ প্রকাশিত এই গবেষণায় অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্টে প্রায় ১১ হাজার গাছের ওপর ৫০ বছরের পর্যবেক্ষণ চালানো হয়। গবেষকরা দেখেছেন, বনের কাষ্ঠল জৈববস্তু, যা সাধারণত বিপুল পরিমাণ কার্বন ধরে রাখে, এখন তা শোষণের পরিবর্তে বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে দিচ্ছে। গবেষণা অনুযায়ী, এই পরিবর্তন প্রায় ২৫ বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে।
ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির বন বাস্তুতন্ত্র গবেষক ও গবেষণার প্রধান লেখক হান্নাহ কার্ল বলেন, শুষ্ক বাতাস, উচ্চ তাপমাত্রা ও খরা—এই তিনটি কারণ গাছ দ্রুত মরে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই বনের গাছগুলো প্রতিবছর একরপ্রতি গড়ে প্রায় ৫৫৩ পাউন্ড কার্বন শোষণ করত। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে একই পরিমাণ এলাকায় প্রতিবছর গড়ে ৮৩০ পাউন্ড কার্বন নিঃসরণ হয়েছে।
এটি বিশ্বের প্রথম কোনো রেইনফরেস্ট, যা কার্বন শোষক থেকে কার্বন উৎসে পরিণত হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। হান্নাহ কার্ল বলেন, “এটি একটি সতর্কবার্তা, যা পৃথিবীর অন্যান্য বনাঞ্চলের ভবিষ্যতের জন্য বিপদের ইঙ্গিত হতে পারে।”
এখন পর্যন্ত অন্য কোনো রেইনফরেস্টে কার্বন নিঃসরণের এমন প্রবণতা দেখা যায়নি। যদিও আমাজন রেইনফরেস্টে মানবসৃষ্ট বন উজাড় ও দাবানলের কারণে এর কার্বন ধারণক্ষমতা কমেছে এবং কিছু অংশ কার্বন উৎসে রূপ নিয়েছে। তবু সেখানকার গাছপালা বায়ুমণ্ডলে কার্বন বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের বৃদ্ধিও কিছুটা বাড়িয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া এখন আরও চরম। ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গাছের মৃত্যু রেইনফরেস্টের কার্বন ধারণক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।
হান্নাহ কার্ল সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’–কে বলেন, “অস্ট্রেলিয়ার আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল অন্য মহাদেশের বনাঞ্চলের তুলনায় তুলনামূলক উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ুতে অবস্থিত। ভবিষ্যতে বিশ্বের অন্যান্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে, এটি হয়তো তার একটি উদাহরণ।”
বিজ্ঞানীরা আগে ধারণা করতেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন বেড়ে গেলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনগুলোও বেশি কার্বন ধারণ করে ভারসাম্য রক্ষা করবে। কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দীর গবেষণা সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির বন গতিবিদ্যা গবেষক রাফায়েল ট্রুভ, যিনি এই গবেষণায় সরাসরি যুক্ত নন, বলেন, “এই দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার তথ্যগুলো দেখাচ্ছে, আগের ধারণাটি সঠিক নয়।”
তিনি আরও বলেন, “জলবায়ু ও পরিবেশের পরিবর্তন বোঝার জন্য এ ধরনের তথ্যভান্ডার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের তত্ত্বকে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে সাহায্য করে।”
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, নেচার
বিডি প্রতিদিন/আশিক