বিশ্বব্যাপী বাবা-মায়েদের মানসিকতায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ঐতিহ্যগতভাবে ছেলেসন্তানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, আর তার জায়গা দখল করছে মেয়েসন্তানের প্রতি আগ্রহ।
একসময় পরিবার গঠনে ছেলেসন্তানকে অর্থনৈতিক ভরসা, বংশ রক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে এখন এই ধারণায় নাটকীয় রূপান্তর দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে জনসংখ্যায় শীর্ষস্থানীয় দুই দেশ চীন ও ভারতে। একসময় এই দুই দেশে আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির অপব্যবহারে বিপুলসংখ্যক মেয়েভ্রƒণ গর্ভেই হত্যা করা হতো। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য টাইমস জানিয়েছে, ১৯৯০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে অন্তত ২ কোটি মেয়েশিশু জন্মের আগেই হারিয়ে গেছে। তবে এ ধারা পাল্টাতে শুরু করেছে।
গবেষণা বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বে মেয়েভ্রƒণ গর্ভপাতের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে মাত্র ১ লাখ ৭ হাজারে, যেখানে ২০০০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৬ হাজার, অর্থাৎ ৭ গুণ হ্রাস।
ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ জার্নালের ২০২৩ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ইউরোপের দেশগুলোতেও মনোভাবের এ পরিবর্তন স্পষ্ট। বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্সে দেখা গেছে, প্রথম সন্তান মেয়ে হলে অনেক বাবা-মা দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। অর্থাৎ মেয়েসন্তানকেই তারা চূড়ান্ত পছন্দ ভাবছেন।
ফিনল্যান্ডে ১৯৮০-এর দশকে মেয়েসন্তানের জন্মের পর বিচ্ছেদের প্রবণতা থাকলেও, ১৯৯০-এর পর থেকে এটি প্রায় পুরোপুরি কমে গেছে, যা সমাজে মেয়েশিশুর প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন।
বাংলাদেশ ও সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে ছেলে ও মেয়ের সংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখাকে এখন পারিবারিক স্থিতির অন্যতম শর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, জাপানে যেসব দম্পতি এক সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের ৭৫ শতাংশই মেয়েসন্তান চান, যেখানে ১৯৮২ সালে এ হার ছিল ৫০ শতাংশের নিচে।
যুক্তরাষ্ট্রেও ‘আইভিএফ’ চিকিৎসায় মেয়েভ্রƒণ বেছে নেওয়ার হার বেড়েছে, যা মেয়েসন্তানের প্রতি অভিভাবকদের চাহিদার বহিঃপ্রকাশ।
কেন এমন পছন্দ : বিশেষজ্ঞদের মতে, মেয়েসন্তানদের সাধারণত যত্নশীল, পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনের মতো দেশে অতিরিক্ত ছেলেসন্তানের ফলে বিয়ে ও সামাজিক স্থিতি নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। ব্রিটেনে ছেলেদের মধ্যে বেকারত্ব, অপরাধপ্রবণতা ও শিক্ষা বিচ্যুতি বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার মেয়েসন্তানকে ‘নিরাপদ ভবিষ্যৎ’ মনে করছেন। একসময় মেয়েসন্তানকে বোঝা মনে করা হতো। আজ সেই ধারণার বদল ঘটছে। সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিবর্তনে মেয়েশিশুর গুরুত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গবেষণার ফলাফলগুলো বলছে, ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতীক হিসেবে এখন মেয়েসন্তানই হয়ে উঠছে সবার প্রথম পছন্দ।
সূত্র : দ্য টাইমস, ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান।