আটবার জাতীয় কিরাত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভকারী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কারি মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও বাকপ্রতিরুদ্ধ হয়ে চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ঢাকার চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী লালবাগ শাহী মসজিদে ৪০ বছরেরও বেশিদিন ধরে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালনকারী পবিত্র কোরআনের এ তাফসিরকারক রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসগৃহে চলৎশক্তিহীন অবস্থায় রয়েছেন প্রায় ৯ বছর ধরে।
যার সুরেলা কণ্ঠ লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে, তিনি আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে। পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ চকবাজারের শাহী মসজিদে পাঞ্জেগানা নামাজসহ পবিত্র জুমার দিনগুলোতে জনাকীর্ণ জামাতের মিম্বরে নিষ্পাপ চেহারার মধ্যমদেহী যে হুজুরের কণ্ঠে লালিত্যময় জলদগম্ভীর সুরে খুৎবা পঠিত হতো, যার অনিন্দ্য দ্যোতনা মুসল্লিদের অন্তরের অন্তঃস্থলকে জান্নাতি মহিমার অন্তরঙ্গ স্পর্শে দোলায়িত করে আবিষ্ট করে রাখত- গত নয় বছর থেকে সেই অলৌকিক কণ্ঠকে মহান আল্লাহ গাফুরুর রাহিম কেন যে স্তব্ধ করে রেখেছেন তা তিনিই ভালো জানেন। মাওলানা কারি মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহর জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কোদালা গ্রামে। পিতা-আল্লামা শাহ মেহেরুজ্জামান। শিক্ষাগত যোগ্যতা-দাওরা হাদিস এবং দাওরা তাফসির-ই-কোরআন। তাজভীদ এবং কিরাতে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত। ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিদিনের রেডিও অনুষ্ঠানের শুরুতে কারি মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহর মর্মস্পর্শী কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য উৎকীর্ণ হয়ে থাকত।
এক অমল সুন্দরবোধ আর স্বপ্নময়তা দিয়ে শুরু হতো বেতারের সারা দিনের অনুষ্ঠানমালা, অসংখ্য শ্রোতা ছিলেন যারা তাদের জন্য তেলাওয়াত অনুষ্ঠানটিকে একমাত্র আকর্ষণ বলে মনে করতেন। পৃথিবী যখন ভোরের রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠত ঠিক সেই মুহূর্তে বেতার তরঙ্গে ধ্বনিত হতো- 'ফাবে আইয়ে আলায়ে রাব্বে কুমা তুকাজ্জিবান'। কিংবা এরকম আরও অনেক অপরূপ পঙ্ক্তিমালা। ঝড়ঝঞ্ঝা, শীত-গ্রীষ্ম এবং আরও নানা দুর্যোগ অসুবিধা অতিক্রম করে ভোরবেলা বেতার মাইক্রোফোনের সামনে তেলাওয়াতের জন্য যারা হাজির হন, মাওলানা কারি মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ তাদের একজন।
সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যমূলক কর্মকৃতির জন্য কিছু মানুষ অসাধারণ হয়ে ওঠেন। আবার বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় কর্মকৃতির পাশাপাশি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য কিছু মানুষ হয়ে ওঠেন অসাধারণ। কারি মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ এমন অসাধারণ মানুষদের একজন।
তার সাধারণ হয়ে ওঠার বৈশিষ্ট্যগুলো হলো : * তিনি আমলে-আখলাকে, চালচলনে, আচার-ব্যবহারে, চূড়ান্তভাবে রসুল (সা.)-এর একনিষ্ঠ অনুসারী।
* নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, পরিমিতিবোধ ও মিতবাক চরিত্রের এক মূর্ত প্রতীক।
* ষড়রিপুর প্রভাব অতিক্রমকারী অন্যায়, মিথ্যা, কপটতা ও স্বার্থবাদিতার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী অকুতোভয় প্রতিবাদপরায়ণ।
* দুনিয়ার প্রাপ্তি তুচ্ছজ্ঞান করে সব সময় মানুষের কল্যাণ ও নিজের আখেরাতের কামিয়াবীর লক্ষ্যে সদা সচেতন এবং আখেরাতের শাস্তির ভয়ে সদা বিচলিত ও বিভোর থাকতেন। অন্যায় ও হারামের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী সোচ্চার কণ্ঠের একটি উদাহরণ বিধৃত হয় মাওলানা লিয়াকত আমিনীর প্রকাশিত একটি লেখায়। যেখানে চকবাজার শাহী মসজিদের খতিব থাকাবস্থায় কারি মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহর এক বক্তব্যের উদ্ধৃতি আছে এরূপ : 'দিন দিন মসজিদে মুসল্লি বাড়লেও মসজিদের প্রতিটি বালিকণা, ইট ইত্যাদি হালাল পয়সার নয়, এতে অনেক হারাম পয়সার মিশ্রণ রয়েছে। তাই মসজিদে প্রদত্ত অনুদানের উৎস সম্পর্কে জানা দরকার। এক্ষেত্রে অবহেলার কারণেই মসজিদ বাড়ছে, মসজিদের জাঁকজমক বাড়ছে, কিন্তু মুমিনের কলবে সালাতের ছোঁয়া খুব কমই লাগছে। আর ইমামরা যেন না হয় কমিটির ফরামায়েশি লোক।' দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এরূপ নির্ভীক প্রতিবাদের নজির কয়টা আছে? তিনিই হলেন কারি মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। মাওলানা কারি ওবায়েদুল্লাহ সুস্থ থাকতে ইসলাম ও দেশ এবং জাতির সেবায় নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন থাকবে মৃত্যুর সঙ্গে অসহায়ভাবে লড়াইরত এই আলেমে দীনের জন্য আজীবন একটি মাসিক সম্মানী ভাতা এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তার সুচিকিৎসায় দেশের অবস্থাপন্ন ধর্মপ্রাণ মানুষ এগিয়ে আসবেন এমনটিই আশা করছি।
লেখক : নোয়াখালীর ভুলুয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ।