হাজার ফুট উঁচু পর্বতচূড়া থেকে তীব্র বেগে নেমে আসা জলস্রোত স্থলভাগ অতিক্রমকালে নাম হয় নদী। এর আরেক নাম তটিনী। উপত্যকা থেকে উপত্যকা পাড়ি দিয়ে সমতলে নেমে আসা নদী পৃথিবীর সঙ্গে ঊর্ধ্বলোকের সেতুবন্ধ রচনা করে। এ সময় দুই দিক থেকে গিরি প্রবাহিণী যোগ দেয় নদীর সঙ্গে। তখন নদীর গতি কিছুটা কমে এলেও এর আয়তন বাড়তে থাকে। নদী তখন যত অগ্রসর হয় আয়তনও ততই বাড়তে থাকে।
নদ-নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছিল অতীতের বড় বড় সভ্যতা। যেমন নীল নদের তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা। বাংলাদেশের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। নদী কেন্দ্র করেই তো সৃষ্টি হয়েছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলার রাজধানী আজকের ঢাকার ইতিহাস।
নদী মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অগণিত নিয়ামতের মধ্যে অনন্য। নদী আমাদের জীবিকা নির্বাহে যেমন পাশে থাকে তেমনি আমাদের পথ চলতেও সহায়তা করে। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকার চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ সুরা বাকারা, আয়াত ১৫৪।
বহুদূর থেকে ছুটে আসা এ নদীকে আমাদের কাছে আসতে অনেক বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছে। কত শত পথ, প্রান্তর, বন, জনপদ পার হয়ে কত গ্রাম ও নগরের পাশ দিয়ে এঁকে-বেঁকে মিলিত হয়েছে সমুদ্রে। সমুদ্রে মিলিত হয়েও তার পথচলা থামে না। অনন্ত সাগর, অনন্ত মেঘ প্রবাহ, পানির অনন্তর উৎস ধারার সঙ্গে নদীও ধারণ করে অনন্ত রূপ।
আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সমান্তরালে দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন। একটি মিষ্টি, তৃষ্ণা নিবারক ও একটি লোনা, বিস্বাদ, উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।’ সুরা ফুরকান, আয়াত ৫৩। নদীমাতৃক দেশ, বাংলাদেশ। এ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদ-নদীর উৎস হিমালয় পর্বত। বাংলাদেশে কমপক্ষে ৭০০ নদ-নদী আছে বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞরা।
তবে নদী-উপনদী-শাখা নদী নিয়ে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। বাংলাদেশে প্রধান নদ-নদী পাঁচটি- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, পশুর ও কর্ণফুলী। এ ছাড়া আছে তিস্তা, গড়াই, মধুমতী, রূপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, গোমতী, কীর্তনখোলা, শীতলক্ষ্যা ইত্যাদি। অপূর্ব সুন্দর নদ-নদীগুলো পৃথিবীর অজ্ঞাত ঝরনাধারার মায়া ছেড়ে আমাদের তার মায়ার বাঁধনে গাঁথতে চায়।
এসব নদ-নদীর পেটে যেন লুকিয়ে আছে অজানা কোনো মায়ার কাঠি। আচ্ছা এই যে নদ-নদী দেখলেই নামতে ইচ্ছা করে, এটাই কি সেই মায়ার কাঠি? এটাই কি নদ-নদীর শক্তি? নদ-নদী নিয়ে এত প্রেম আর ভালোবাসার এত যে উপাখ্যান তার পরও কমেনি নদ-নদীর দুঃখ। তার কারণ বাংলাদেশে নদ-নদী দখলের হুজুগ সেই যে শুরু হয়েছে, এখনো থামার নাম নেই।
প্রায়ই পত্রিকার পাতা, টিভির স্ক্রিনে দেখা যায় কোনো না কোনো নদ-নদী দখলের খবর। কখনো কখনো ছোটখাটো নদ-নদীর মাঝখানে জাল পেতে জলস্রোত বন্ধ করে চালায় মাছ নিধনের উৎসব। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণ যে জলস্রোতে রাখা, সে জলস্রোতে হামলা, অবরোধ আর জবরদখলের মতো নিন্দনীয় ঘটনা আত্মহননের মতোই নয় কি?
এ দেশেরই কিছু মানুষ নদ-নদীর মরুকরণের যে আত্মঘাতী প্রক্রিয়া চালাচ্ছে, তা প্রতিকারের জন্য আজও কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না বা চোখে পড়ছে না। জবরদখল ছাড়াও শিল্প বর্জ্য, মানুষ ও প্রাণীর মলমূত্র নদ-নদীকে বিষাক্ত করে তুলছে অবিরাম। নদ-নদীর দুঃখ ঘুচাতে, নদ-নদীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে আমাদের অতিদ্রুত এগিয়ে আসা দরকার। কেননা নদ-নদী আমাদের পথপ্রদর্শক।
আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘এবং তিনিই পৃথিবীর ওপর বোঝা রেখেছেন যে কখনো যেন তা তোমাদের নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা পথ প্রদর্শিত হও।’ সুরা নাহল, আয়াত ১৫। নদী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। নদী বাঁচলেই এ সৌন্দর্য থাকবে। তাই নদীকে বাঁচাতে সরকারকে যেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে তেমনি আমাদেরও নদী প্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি আউলিয়ানগর।
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর