পবিত্র কোরআন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস। মানুষের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম।’(সুরা : নাহল, আয়াত : ৮৯)
কোরআনে বর্ণিত জ্ঞান আহরণের জন্য আল্লাহ মানবজাতিকে বারবার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘এক কল্যাণময় কিতাব, এটা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতগুলো অনুধাবন করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা গ্রহণ করে উপদেশ।’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ২৯)
কোরআনের পাঁচ আলোচ্য বিষয়
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) বলেন, পবিত্র কোরআনে যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা মৌলিকভাবে পাঁচ ভাগে বিভক্ত।
১. ইলমুল আহকাম বা বিধান শাস্ত্র : যার অধীনে নিয়ম-নীতি ও আইনের আলোচনা করা হয়েছে। ইবাদত, লেনদেন, পারিবারিক ও সামাজিক আচরণ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে শরিয়তের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
যেগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—ক. ফরজ, যা মুমিনের জন্য অনিবার্য, খ. ওয়াজিব, যা আবশ্য করণীয়, গ. মানদুব বা মুস্তাহাব, যা করা প্রশংসনীয়, ঘ. মুবাহ, যা করা বৈধ এবং যাতে কোনো দোষ নেই, ঙ. মাকরুহ, যা করা অপছন্দনীয়, চ. হারাম, যা করা নিষিদ্ধ এবং পরিহার করা আবশ্যক। এই শাস্ত্রে যাঁরা পারদর্শী ইসলামী পরিভাষায় তাঁদের ফকিহ বা আইনজ্ঞ বলা হয়।
২. ইলমুল জাদাল বা বিতর্ক শাস্ত্র : যেহেতু ইসলাম কেবল ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই বিতর্কের অনুমতি দেয়, তাই ইলমুল জাদালকে ন্যায়শাস্ত্রও বলা হয়।
মূলত ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিক ও মুনাফিক—এই চারটি বিভ্রান্ত দলের সঙ্গে বিতর্কে পারদর্শিতা লাভের জন্য এই জ্ঞান চর্চা করা হয়। এই জ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দায়িত্ব মুতাকাল্লিম বা ধর্মতাত্ত্বিকদের ওপর ন্যস্ত।
৩. ইলমুত তাজকির বিআলাইল্লাহ বা স্রষ্টাতত্ত্বের জ্ঞান : সৃষ্টিজগতে আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতা, ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের প্রতিফলন নিয়ে এই শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়। এতে মহাবিশ্বের সৃষ্টির রহস্য, তার পেছনে আল্লাহর অভিপ্রায়, মহাবিশ্বের শৃঙ্খলায় আল্লাহর কুদরত, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে আল্লাহর নিদর্শনাবলি, আল্লাহর গুণাবলি ও পরিচয়, দৈনন্দিন জীবনে প্রাপ্ত বান্দার অভিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
৪. ইলমুত তাজকির বিআইয়ামিল্লাহ বা সৃষ্টিতত্ত্বের জ্ঞান : আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুসমূহের অবস্থা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এদের মধ্যে যারা আল্লাহর অনুগত তাদের পুরস্কৃত এবং যারা অবাধ্য তাদের শাস্তি প্রদানের ঘোষণা রয়েছে।
৫. ইলমুত তাজকির বিল মাউতে ওয়াল আখিরাত বা মৃত্যু ও পরকাল বিষয়ক জ্ঞান : মৃত্যু ও তার পরবর্তী জীবনের অবস্থাগুলো এই শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়। এতে পুনরুত্থান, একত্রীকরণ, হিসাব-নিকাশ, জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা করা হয়। যাঁরা এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জন করেন এবং মানুষকে সতর্ক করেন তাঁদেরকে ওয়ায়েজ বা উপদেশদাতা ও সতর্ককারী বলা হয়।
কোরআনের বর্ণনারীতি
উল্লিখিত বিষয়গুলো বর্ণনার সময় কোরআন নিজস্ব রীতি-নীতিই অনুসরণ করেছে। এর সঙ্গে তৎকালীন আরবদের ভাষা ও ভঙ্গির মিল রয়েছে। পরবর্তী যুগের আরবদের বর্ণনারীতির সঙ্গে এর খুব বেশি মিল নেই। বস্তুত আহকাম বা বিধান সম্পর্কিত আয়াত বর্ণনার ক্ষেত্রে সংক্ষেপণের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। তাতে নীতিনির্ধারকদের মতো অহেতুক বিশ্লেষণ ও মীমাংসার অজুহাতে আলোচনা দীর্ঘায়িত করা হয়নি।
বিতর্ক শাস্ত্রের বর্ণনায় আল্লাহ সর্বজনসম্মত নীতি ও কল্যাণকর উপদেশ প্রদান করেছেন। এতে সহজ ভাষা ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। তর্কবিদদের মতো যুক্তির মারপ্যাঁচে ধাপে ধাপে আগানোর দীর্ঘ পথ অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি পরবর্তীকালের গদ্য লেখকদের মতো বিভিন্ন কথার গাঁথুনি রচনা করে একটি কথা বোঝাতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা হয়নি। সর্বোপরি বলা যায়, বান্দার জন্য যখন যেখানে যা যতটুকু প্রয়োজন কোরআনে ততটুকুই বর্ণনা করা হয়েছে। এতে আগ-পর ধারাবাহিকতার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন