হজ এক আধ্যাত্মিক মহাসম্মেলন, মানবতার এক নিঃশব্দ ধ্বনি, এক চেতনার উৎসার। সময়ের সীমানা অতিক্রম করে, কোটি হৃদয় একত্র হয় পবিত্র বায়তুল্লাহর চারপাশে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ এই হজ কেবল এক ধর্মীয় অনুশাসন নয়; আধুনিক বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও পরিবেশবিদ্যার বিবেচনায় এটি এক বিস্ময়কর অনুশীলন।
আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘এবং মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে, যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) রোগা হয়ে গেছে।’ (সুরা : আল হজ, আয়াত : ২৭)।
অন্যত্রে বলা হয়েছে : ‘আর এ (কাবা) ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর ফরজ, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না, আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।’ (সুরা : আল ইমরান, আয়াত : ৯৭)
১. ইহরাম ও পরিচ্ছন্নতার আধুনিক প্রজ্ঞা
পুরুষদের জন্য ইহরাম হলো দুটি সাদা অমসৃণ কাপড়, যা প্রতীক মাত্র নয়; এটি মানবসমতার বার্তা বহন করে এবং জীবাণুবিরোধী সুবিধাও প্রদান করে। ইবনে উমর (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) জুল-হুলাইফার মসজিদের কাছ থেকে ইহরাম বেঁধেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫৪১)
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ :
গবেষণা অনুযায়ী, অজান্তে আমাদের পরিধেয় কাপড়ে ৪০ হাজারের বেশি জীবাণু বাস করে (Zeigler, Journal of Medical Hygiene, 2016)। দুই টুকরা ইহরামের কাপড় কম ফাইবার বহন করে এবং দ্রুত শুকিয়ে যায়, যা জীবাণু বৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করে। (Zeigler, H. (2016). Microbial Load on Human Clothing : A Comparative Studz. Journal of Medical Hygiene, Vol. 12(3), pp. 134-141.
২. তাওয়াফ ও চৌম্বকীয় কেন্দ্রবিন্দু
কাবাকে ঘিরে সাতবার প্রদক্ষিণ ‘তাওয়াফ’ একটি আধ্যাত্মিক কর্মযজ্ঞ, যার কেন্দ্রবিন্দু পৃথিবীর মধ্যখানে। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘অতঃপর (যারা হজ করে) তারা যেন তাদের মলিনতা দূর করে ও নিজেদের মানত পূরণ করে এবং সুসংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে।’ (সুরা : আল হজ, আয়াত : ২৯)।
বৈজ্ঞানিক দিক :
Jack The Lad-এর ‘Centre of earth’ শিরোনামের থিসিস অনুযায়ী, কাবা অবস্থিত পৃথিবীর ভূগোলিক কেন্দ্রে (Geodetic Center), যেখানে চৌম্বকীয় শক্তির এক আশ্চর্য ভারসাম্য বিরাজ করে (Professor Zayde Antrim. Associate Professor of History and International Studies: Trinity College faculty member since 2006, Geology Review, 2004, p. 88)
মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্ক এই কেন্দ্রীভূত ঘূর্ণনে এক প্রকার neurological synchronization অনুভব করে, যা মেডিটেশন থেরাপির মতো প্রশান্তিদায়ক।
৩. ‘সাঈ’ প্রতীকী ধৈর্য ও মনোবিকাশ
সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌড়ানো- হাজেরা (আ.)-এর বিস্ময়কর ঈমানি ত্যাগের স্মারক। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : ‘নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তাআলার নিদর্শনসমূহের অন্যতম।’ (সুরা : আল বাকারাহ, আয়াত : ১৫৮)।
স্নায়ু ও মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ :
এই কর্মযজ্ঞ Resilience theory-এর বাস্তব রূপ, যেখানে এক মা নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে কষ্টকর পরিস্থিতিতে ছুটে চলেছেন।
Harvard-এর মনোবিজ্ঞানী Dr. Daniel Goleman বলেন, ‘Szmbolic repetition in religious acts strengthens neural resilience and cognitive focus.’‘ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে প্রতীকী পুনরাবৃত্তি মস্তিষ্কের সহনশীলতা ও মনঃসংযোগ শক্তিকে দৃঢ় করে।’ (Emotional Intelligence, 2006, p. 212) এছাড়া Newberg, A & Waldman, M. R. (2009). How God Changes Your Brain.
এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, দোয়া, জিকির, মেডিটেশন ইত্যাদি পুনরাবৃত্তিমূলক ধর্মীয় কর্মকাণ্ড কিভাবে নিউরোনাল প্লাস্টিসিটি বাড়িয়ে তোলে এবং মনঃসংযোগ ও মানসিক স্থিতিশীলতা গঠনে সহায়তা করে।
৪. জমজমের পানি : প্রাণবৈজ্ঞানিক বিস্ময়
ইসমাঈল (আ.)-এর কান্না ও হাজেরা (আ.)-এর ছুটে চলার ফসল জমজম। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম পানি হলো জমজমের পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের পরিপূরকতা ও রোগের জন্য আরোগ্য। (আল জামিউস সহিহ, হাদিস : ৩৩২২)
বৈজ্ঞানিক গবেষণা : King Saud University-এর গবেষণায় (২০১১) জমজমের পানিতে উচ্চমাত্রার ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফ্লোরাইড পাওয়া গেছে, কিন্তু কোনো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নেই (J. King Saud Univ. Med Sci., Vol. 23, Issue 3, p. 120~125). পানির স্বচ্ছতা ও খনিজ ভারসাম্য হৃদরোগ প্রতিরোধ ও হজমক্রিয়া উন্নত করে।
৫. আরাফা-সমবায়ের মহাসম্মেলন
আরাফাতের ময়দান যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মানবিক অভিসার। আবদুর রহমান বিন ইয়ামুর আদদিলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : হজ হলো আরাফা; যে ব্যক্তি আরাফার ময়দান পেয়েছে (ওখানে ফজরের নামাজের ওয়াক্তের আগে উপস্থিত হয়েছে), সে হজ অর্জন (পূর্ণ) করেছে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৯৪৯)
এখানে শ্রেণি, জাত ও বর্ণের তফাত নেই, রাজা-ভিখারি এক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকে—এ যেন বাস্তব Universal Declaration of Equality।
সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ :
United Nations-এর সমাজতত্ত্ব গবেষণায় দেখা যায়, হজকালীন আরাফাতের সমাবেশ বিশ্বে আন্তঃধর্মীয় সহনশীলতার অন্যতম নিদর্শন। (UN Social Behavior Review, 2019, Vol. 17, p. 89–94)
৬. শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ
মিনায় প্রতীকী শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ : জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরবানির দিন সূর্য কিছুটা ওপরে উঠলে জামারায় পাথর নিক্ষেপ করেন, পুনরায় দ্বিপ্রহরের পরে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২৯৯)।
মনোবিজ্ঞানে এর ব্যাখ্যা :
Carl Jung এই ধরনের প্রতীকী আত্মসংযমকে ‘Shadow Suppression’ বলেছেন, যা মানুষকে তার নিচু প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সচেতন করে তোলে। (Jung, The Archetypes, 1959, p. 144)
৭. কোরবানি ও খাদ্যনীতি
হজে পশু কোরবানি কেবল আধ্যাত্মিক নয়, খাদ্য বণ্টনের এক মহান কর্মসূচি। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘সুতরাং (হে মুমিনরা!) সেই পশুগুলো (কোরবানি) থেকে তোমরা নিজেরাও খাও এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও।’ (সুরা : আল হজ, আয়াত : ২৮)।
সামাজিক বিশ্লেষণ :
প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ টন কোরবানির মাংস বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণ করা হয়- বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এক অলিখিত সহযোগী (Saudi Gazette, 2022)। এটি ইসলামী অর্থনীতির জাকাত ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রতিচিত্র।
মোটকথা, হজ এক আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা, কিন্তু একই সঙ্গে তা মন, দেহ, বিজ্ঞান, সমাজ-সব কিছুর সামগ্রিক এক চর্চা। এর প্রতিটি অনুষঙ্গ এমনভাবে গঠিত, যা মানুষকে শুদ্ধ করে, সমাজকে সংহত করে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রশান্তি এনে দেয়।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক, জামিয়া মাদানিয়া শুলকবহর, চট্টগ্রাম।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ