আলবেনিয়ার সাংবিধানিক নাম ‘রিপাবলিক অব আলবেনিয়া’, যা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপে অবস্থিত। আলবেনিয়ার উত্তর-পূর্বে কসোভো, উত্তরে উত্তর মেসিডোনিয়া, উত্তর-পশ্চিমে মন্টিনিগ্রো, দক্ষিণে গ্রিস এবং পশ্চিমে আড্রিয়াটিক সাগর অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে আলবেনিয়া বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। শিল্প, বাণিজ্য, পর্যটন, আবাসন, কৃষি ও মৎস্য সম্পদ আলবেনীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
আলবেনিয়ার মোট আয়তন ২৮ হাজার ৭৪৮ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটির মোট জনসংখ্যা ২৪ লাখ দুই হাজার ১১৩ জন। যার মধ্যে ৫১ শতাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং ১৬ শতাংশ খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। তবে আবর গণমাধ্যমগুলোতে আলবেনিয়ার জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মুসলিম বলে দাবি করা হয়।
আলবেনিয়ার বেশির ভাগ মুসলিম সুন্নি ও হানাফি মাজহাবের অনুসারী। আলবেনিয়ার রাষ্ট্রীয় ভাষা আলবেনীয়। তিরানা আলবেনিয়ার রাজধানী শহর।
আলবেনীয় জাতির উৎপত্তি হয়েছিল মধ্য এশিয়ায়।
সেখান থেকে তারা বলকান অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তবে আলবেনিয়ায় খ্রিষ্টপূর্ব সাত হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান ও গ্রিকরা বলকান অঞ্চলে আগমন করে। তাদের পরে আসে স্লোভকরা। এসব জাতির আগমনে আলবেনীয়রা সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত হয় এবং তারা সীমাহীন নিপীড়নের শিকার হয়।
অবশেষে ইসলাম তাদের মুক্তি দেয়।
ইসলামপূর্ব সময়ে আলবেনিয়ার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মূর্তি পূজারি ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৮ সালে দীর্ঘ সংঘর্ষের পর আলবেনিয়া দখল করে। ৩৮০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে আলবেনিয়ায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের সুযোগ তৈরি হয়। তবে স্থানীয় জনগণ কখনোই রোমান শাসন ও তাদের ধর্ম মেনে নেয়নি। ফলে তারা বারবার বিদ্রোহ ও সংঘাতে লিপ্ত হয়। রোমান শাসন থেকে মুক্তি লাভের জন্য আলবেনীয়রা উসমানীয়দের সাহায্য কামনা করে। উসমানীয় বাহিনী ১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দে আলবেনিয়ায় সর্বপ্রথম বিজয় লাভ করে। ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয়রা তাদের শাসনাধীন অঞ্চলের বিস্তৃতি ঘটায় ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে আলবেনিয়া পুরোপুরি মুসলিম শাসনাধীন হয়।
মুসলমানদের ইনসাফ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ শাসন এবং ইসলামের সুমহান আদর্শ আলবেনীয়দের মুগ্ধ করে। ফলে দেশটিতে দ্রুত ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে আলবেনিয়ায় ইসলামের প্রথম পদার্পণ ঘটে। আলবেনিয়ায় ইসলাম প্রচারে মুসলিম বণিক ও ধর্ম প্রচারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। উসমানীয়দের আগেই আলবেনিয়ায় ইসলাম প্রসারের প্রমাণ হলো বিরাত দুর্গের লাল মসজিদ।
উসমানীয়রা আলবেনিয়ায় বহু সেবামূলক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। তারা রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন নতুন শহর নির্মাণ করে। তাদের নির্মিত কয়েকটি শহর হলো শকোদার, এলবাসান, বেরাত, তিরানা (রাজধানী), জিরোকাস্ত্রা, প্রিজরেন, পেজা, জাকোভা ইত্যাদি।
১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আলবেনিয়া ওই বছরের ২৮ নভেম্বর স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৩ সালে লন্ডন কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় শক্তিগুলো আলবেনিয়াকে স্বীকৃতি দেয়। তবে তারা আলবেনিয়ার দাবিকৃত প্রায় ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটারের পরিবর্তে মাত্র ২৮ হাজার ৭৪৮ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল নির্ধারণ করে। স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে আলবেনীয় মুসলিমদের দুর্দিন শুরু হয়। ১৯২৮ সালে আহমদ জোগো ক্ষমতা গ্রহণ করে। সে ছিল চরম ইসলামবিদ্বেষী। সে মসজিদভিত্তিক দ্বিনি শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং মাদ্রাসা শিক্ষা নিষিদ্ধ করে। তার পরও আলেমরা ধর্মীয় বই-পুস্তক রচনা অব্যাহত রাখেন। শেখ আলী কারাজা আলবেনীয় ভাষায় কোরআন অনুবাদ করেন, যা ন্যূনতম ইসলামী শিক্ষা বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল।
১৯৩৯ সালে ইতালি আলবেনিয়া দখল করে। তখন আলবেনিয়া খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের সর্বাত্মক চেষ্টা করে। ইতালি সরকার আলবেনিয়ার অসংখ্য মসজিদ ও মাদ্রাসা ধ্বংস করে। বিপুলসংখ্যক আলেমকে হত্যা করে। তাদের অনেককে বন্দি এবং অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে ইনভার হোক্সার (পূর্ব নাম আনওয়ার পাশা হোক্সা) নেতৃত্বে আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত। তারা আলবেনিয়াকে বিশ্বের একমাত্র ধর্মহীন দেশ ঘোষণা করে। ইনভার হোক্সার সরকার নির্বিচারে মুসলিম গণহত্যা চালায় এবং মুসলিম জনসাধারণকে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ১৯৮৯ সালে আলবেনিয়ায় এক গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে। তখন থেকে মুসলিমরা ধর্ম পালনে কিছুটা স্বাধীনতা লাভ করে। তারা মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের অনুমতি পায়। তবে দীর্ঘদিনের ইসলামবিদ্বেষী শাসনের ক্ষত এখনো তারা বহন করে যাচ্ছে। মুসলমান ও জনসাধারণের বড় একটি অংশ এখনো ধর্মবিমুখ। আরব দেশগুলোর সহযোগিতায় একাধিক মুসলিম সাহায্য সংস্থা মুসলমানদের ভেতরে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে।
সূত্র : ইসলাম ওয়েব ডটনেট, আলুকা ডটনেট ও দাওয়াহ ডট সেন্টার
বিডি প্রতিদিন/কেএ