ভালোবাসা এক অপার রহস্য, আর আত্মসমর্পণ তার চূড়ান্ত রূপ। মানুষ যখন আল্লাহর প্রতি তার গভীরতম ভালোবাসাকে প্রার্থনার পাঁজরে বেঁধে আত্মসমর্পণের দিকে এগিয়ে যেতে চায়, তখনই সে হজে রওনা দেয়। হজ কেবল একটি ইবাদত নয়, এটি এক প্রেমিক হৃদয়ের রবের দরবারে একনিষ্ঠ আত্মনিবেদনের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যেখানে দেহ, মন ও আত্মা সবকিছু বিমগ্ন হয় একজন প্রিয়তমের দিকেই।
ইহরাম অবস্থায় শুভ্রতার অবগাহনে ডুবন্ত ব্যক্তি যখন দুনিয়াবি পরিচয়ের সব আবরণ খুলে ফেলে, তখন সে নিজের অস্তিত্বকে আল্লাহর কাছে সঁপে দেয়।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘যারা হজ করবে, তারা যেন ইহরামের অবস্থায় অশ্লীলতা, গুনাহ ও কলহ পরিহার করে...’ (সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ১৯৭)
এই আয়াত হজের মহাকাব্যিক প্রেমলীলায় প্রবেশকারী আত্মাকে একটি আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার সংকেত দেয়, যা বাহ্যিক পোশাকের চেয়েও গভীরতর।
তারপর আল্লাহপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে নিজেকে তাঁর কাছে সঁপে দেওয়া ব্যক্তি যখন বাইতুল্লাহর তাওয়াফে রত হয়, তখন তার চারপাশে ঘূর্ণন শুধু শরীরের নয়, বরং তা হয়ে ওঠে তৃষিত হৃদয়ের দিশাপ্রাপ্তির আর্তনাদ, যেখানে প্রতিটি চক্কর আল্লাহর প্রেমে আরো এক ধাপ বিলীন হওয়ার নামান্তর। বিখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কাবায় তাওয়াফ করতে দেখেছি, আর তিনি বলছিলেন—‘হে কাবা! কতই না মহান তুমি! কিন্তু মুমিনের সম্মান তোমার চেয়েও বড়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০৩২)
মুসলিম জীবনে বাইতুল্লাহ এক ভালোবাসার কেন্দ্র।
এখানে এসে প্রেমিক আত্মা উপলব্ধি করে যে অন্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে শুধুই এক রবের অবস্থান হতে পারে। দুনিয়ার অন্য কোনো মত ও পথের জায়গা সেখানে ক্ষীণতর।
হজের এক অপূর্ব অধ্যায় সাফা-মারওয়ার সাঈ, যেখানে হাজেরা (আ.)-এর প্রেম আর ভরসার গল্প জড়িয়ে আছে প্রতিটি দৌড়ে। সন্তানের জন্য পানির খোঁজে বারবার দৌড়ানো সেই মা, যাঁর চোখে ছিল না কোনো অভিযোগ, ছিল কেবল বিশ্বাস।
সেই বিশ্বাসই আজ প্রতিটি হজযাত্রীর জন্য এক প্রেমময় দৌড়, যা আল্লাহর দিকে ছুটে চলা ভালোবাসার এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হাজেরা (আ.) যখন ছুটে ছুটে পানি খুঁজছিলেন, তখন জিবরাইল (আ.) এসে জমজমের স্থান নির্ধারণ করেন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিয়েছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৩৬৪)
এই দৌড় বা সাঈ আমাদের শেখায় আল্লাহর পথে ছুটে চললে কিভাবে পথ সৃষ্টি হয়।
আরাফাতের ময়দান, সে তো কান্নার উপত্যকা আর আকুতিভরা হৃদয়ের প্রেমময় গগনস্পর্শী পর্বত। আরাফাতের ময়দানে যিনি উপস্থিত থাকেন না, তাঁর হজ পূর্ণ হয় না। আরাফাহ হলো আত্মসমর্পণের দিবস। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হজ তো আরাফাহ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮৯১)
এখানে দাঁড়িয়ে বান্দা যেন আল্লাহর সামনে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার সব গুনাহ তুমি জানো, আমি জানি না তুমি আমাকে ক্ষমা করবে কি না, কিন্তু আমি জানি তুমি ক্ষমাশীল। এই বিশ্বাসেই আমি এসেছি।’ (এই কথার দালিলিক প্রমাণ না পেলেও অনেক মুসলিম স্কলারের মুখে এটি শোনা যায়) এই বিশ্বাস, এই কান্না, এই ভরসা—সব মিলিয়ে আরাফাহ হয়ে ওঠে আত্মার প্রেম নিবেদনের সমাবেশ।
হজে কোরবানির মাধ্যমেও আসে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত উপলব্ধি। ইবরাহিম (আ.)-এর সেই প্রেম, সেই আত্মনিবেদন, যেখানে পিতা কাঁপা হাতে ছেলের গলায় ছুরি চালাতে প্রস্তুত হন—এ যেন ভালোবাসার এমন এক চূড়ান্ত পরীক্ষা, যেখানে প্রেমিকের কাছে প্রভুর আদেশই সর্বোচ্চ। কাজেই কোরবানি কেবল পশু জবাই নয়; বরং আল্লাহর নাফরমানিতে প্রলুব্ধকারী আত্মার পশুত্ব, প্রবৃত্তির অহংকার, মনুষ্যত্বের তলানিতে থাকা কুপ্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দেওয়ার আরাধনা।
হজ হলো আত্মার আলোকযাত্রা। এটা কেবল বিধান পালনের আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং হজ এমন এক আরাধ্য প্রেমের প্রকাশ, যেখানে বান্দা তার সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে বলে—‘হে আমার রব! আমার জীবন, আমার মৃত্যু, আমার নামাজ ও আমার কোরবানি; সবকিছু তোমারই জন্য।’
(সুরা : আনআম , আয়াত : ১৬২)
কাজেই বলা যায় যে হজ এক প্রেমিক হৃদয়ের হিজরত, যে দুনিয়ার মোহ, সময়ের আড়াল, দুঃখ-ক্লান্তির আবরণ ভেদ করে পৌঁছতে চায় তার আপন রবের কাছে। হজ শেষে যে হৃদয় ফিরে আসে, সে আর আগের মতো থাকে না। সে ফিরে আসে এক নতুন আলো নিয়ে, এক পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে, যা ভালোবাসার এক শাশ্বত আত্মসমর্পণের ফল।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নববী আদর্শের আলোকে হজ সম্পাদনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
বিডি প্রতিদিন/মুসা