নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরতের পর আজানের বিধান প্রবর্তিত হয়। এর আগে মুসলমানরা আজানের কোনো বিশেষ সংকেত ছাড়াই মসজিদে নববীতে উপস্থিত হয়ে যেতেন। এতে অনেকে সময়মতো জামাতে শরিক হতে পারতেন না। বিষয়টি নিয়ে সাহাবিরা নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে পরামর্শে বসেন।
তখন একেক সাহাবি একেক ধরনের প্রস্তাব দেন। কেউ বলেন, আজানের সময় হলে দায়িত্বশীল একজন উঁচু কোনো স্থানে দাঁড়িয়ে ঝাণ্ডা উড়াবেন। আরেকজন বলেন, একজন আগুন জ্বালিয়ে অন্যদের নামাজের সময়ের বিষয়ে জানাবেন। আবার অনেকে পরামর্শ দেন যে নামাজের সময় হলে খ্রিস্টানদের ঘণ্টা বাজানো হোক।
কেউ আবার পরামর্শ দিলেন নামাজের সময় হলে ইহুদিদে মতো ঢোল বাজানো হোক। রাসুল (সা.) পরমার্শ সভার চারটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ ঝাণ্ডা উড়ালে সব মানুষ দেখতে পাবে না। দ্বিতীয়ত, আগুন প্রজ্বালন অগ্নি উপাসকদের কাজ।
তৃতীয়ত, ঘণ্টা বাজানো খ্রিস্টানদের সঙ্গে সাদৃশ্য আর চতুর্থত, ঢোল বাজানো ইহুদিদের সঙ্গে মিলে যায়। এ কারণে সেদিন সমাধান ছাড়াই পরামর্শ সভা মুলতবি করা হয়। রাসুল (সা.) সবাইকে এ বিষয়ে আরো ভাবার পরামর্শ দেন। সে রাতে আজান বা নামাজের আহ্বানের জন্য ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.)। ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্নে দেখলেন—একদল লোক একটি ঘণ্টা নিয়ে কোথাও যাচ্ছে।
তিনি তাদের কাছ থেকে ঘণ্টা কিনে নিতে চাইলেন। তারা তাঁর কাছে ঘণ্টা কেনার কারণ জানতে চাইলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নামাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে সবাইকে একত্র করতে চাই, কিন্তু কোন নিয়মে সবাইকে একই সময়ে একত্র করব তা ভেবে ঠিক করতে পারছি না কেউ। তাই তোমাদের এই ঘণ্টা কিনে নিতে চাইছি, যেন ঘণ্টা বাজিয়ে সবাইকে একত্র করতে পারি।’ তাঁর কথা শুনে সেই কাফেলার লোকেরা বলল, নামাজের জন্য সবাইকে একত্র করতে এই ঘণ্টা কেনার দরকার নেই, আমরা তোমাকে কিছু সুন্দর শব্দ শিখিয়ে দিচ্ছি। এগুলোর মাধ্যমে তোমরা নামাজের সময় সবাইকে ডাকতে পারবে। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.)-কে আজানের শব্দগুলো শিখিয়ে দেওয়া হয়।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে গেলেন এবং স্বপ্নের ঘটনা বিস্তারিত জানালেন। তাঁর স্বপ্নের কথা শুনে ওমর ফারুক (রা.) বলেন, ‘আমিও স্বপ্নে হুবহু এই শব্দগুলো শুনেছি।’ আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ, ওমর (রা.) ছাড়াও আরো একাধিক সাহাবি সেই রাতে একই স্বপ্ন দেখেন। সবার কথা শুনে রাসুল (সা.) এই শব্দগুলোর মাধ্যমেই আজান দেওয়ার অনুমোদন দিলেন এবং বিলাল (রা.)-কে ডেকে আজান দিতে বলেন। এভাবেই মুসলিম সমাজে আজানের প্রচলন ঘটেছে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৮)
নবী (সা.)-এর সময় মুয়াজ্জিন
হাদিসবিশারদদের মতে, নবী (সা.)-এর সময় তিনজন মুয়াজ্জিন ছিলেন। আয়েশা (রা.) বলেন : ‘নবী (সা.)-এর তিনজন মুয়াজ্জিন ছিলেন! বিলাল ইবনে রাবাহ, আবু মাহজুরাহ এবং ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)।’
ঐতিহাসিকরা আরো একজনের কথা উল্লেখ করেছেন যে চতুর্থ মুয়াজ্জিন ছিলেন সাদ আলকারজ (রা.), যিনি কুবা মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্বে ছিলেন। এই মুয়াজ্জিনদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো—
বিলাল ইবনে রাবাহ (রা.) : তিনি আবু আব্দুল করিম, আবু আবদুল্লাহ বা আবু আমর নামেও পরিচিত ছিলেন, তাঁর মা ছিলেন হামামা। তিনি ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর মুক্ত দাস। বিলাল ইবনে রাবাহ প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন এবং বদরের যুদ্ধসহ প্রায় সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর জন্য আজান দেন। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর তিনিই কাবার ছাদে উঠে আজান দিয়েছিলেন। নবী করিম (সা.)-এর মৃত্যুর পর উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খিলাফতের সময় শাম বিজয় হলে খলিফা ওমর (রা.) বিলাল (রা.)-কে আজান দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠান। তখন মুসলমানরা আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।
আবু মাহজুরাহ (রা.) মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি নবী করিম (সা.)-কে বিলাল (রা.)-এর সঙ্গে আজান দিতে প্রস্তাব করেছিলেন। নবী (সা.) এতে সম্মত হন এবং বিলাল (রা.) ফজরের নামাজের জন্য আজান দিতেন। নবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবিরা যখন মক্কায় হিজরত করেন, তখন সব নামাজের জন্য আজান দিতেন। নবী (সা.) নিজেও বলেন, ‘যদি আজান না থাকত, তাহলে আমিও হিজরত করতাম না।’
ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) ছিলেন প্রথম হিজরতকারীদের একজন। তিনি মদিনায় নবী (সা.)-এর মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খিলাফতের শেষের দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন।
সাদ আলকরজ (রা.) আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মুক্ত দাস ছিলেন। তিনি কুবা মসজিদে আজান দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। বিলাল (রা.)-এর অনুপস্থিতিতে এবং তাঁর মৃত্যুর পর মসজিদে নববীতে আজান দিতেন। এরপর তাঁর মৃত্যুর পর এই দায়িত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর সন্তানদের মধ্যে চলে আসে।