শিরোনাম
২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৭:৩৯
পাশে থাকার বার্তা নিয়ে দেখা করতে পারেন মমতা

অমর্ত্য সেনের জমি বিতর্কে লেগেছে রাজনীতির রং

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

অমর্ত্য সেনের জমি বিতর্কে লেগেছে রাজনীতির রং

অমর্ত্য সেন। ফাইল ছবি

নোবেল জয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে ঘিরে বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিনই নিত্যনতুন অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ চলছেই।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বিশ্বভারতীতে জোর করে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে। এই ইস্যুতে ইতোমধ্যেই অমর্ত্য সেনকে তিনবারের বেশি চিঠি ধরিয়েছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। 

এ মুহূর্তে অমর্ত্য সেনের শান্তিনিকেতনের ‘প্রতীচী’ বাড়িটি এখন সংবাদ শিরোনাম। কারণ, অমর্ত্য সেন ১৩ ডেসিম্যাল অতিরিক্ত জমি দখল করে রেখেছেন- আর এই অভিযোগ তুলে জমি ফেরত চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে অমর্ত্য সেনের ব্যাখা ছিল, যে কেউ এই দাবি করতেই পারে। তিনিও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে আইনজীবী মারফৎ চিঠি দেবেন। 

প্রসঙ্গত, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন অমর্ত্য সেনের দাদা পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন। সেই সময় তাকে বসবাসের জন্য আশ্রম সংলগ্ন সুরুল মৌজায় একটি জমি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি, স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অমর্ত্য’ নামকরণ করেছিলেন। সেই অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

শান্তিনিকেতন চত্বরে ‘প্রতীচী’ নামে অমর্ত্য সেনের যে বাড়িটি রয়েছে, অভিযোগ তাতেই নাকি জোর করে অতিরিক্ত জায়গা দখল করে রেখেছেন এই নোবেল জয়ী অধ্যাপক। তাকে উদ্ধৃত করে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে ‘আপনি ১.৩৮ একর জমির দখলে রেখেছেন, যা আপনার ১.২৫ একরের আইনি অধিকারের চেয়ে বেশি। দয়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জমিটি বিশ্বভারতীকে ফেরত দিন। কারণ, জমির আইনের প্রয়োগ আপনার জন্য এবং বিশ্বভারতীর জন্যও বিব্রত হবে। আপনি জানেন যে, অবৈধভাবে দখল জমি পুনরুদ্ধারের পদ্ধতিটি জমির সুপ্রতিষ্ঠিত আইন অনুসরণ করে।’ একই সঙ্গে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ পুরনো চিঠিও পেশ করেছে।

শেষবার চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি চিঠি পেশ করা হয় ভারতরত্ন অমর্ত্য সেনকে। এবার জমির পর্চা ও আনুসাঙ্গিক সামগ্রিক তথ্য দিয়েছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। 

মূলত ১৩ ডেসিমেল জমি নিয়ে অমর্ত্য সেন ও উপাচার্যকে ঘীরে বির্তকের দানা বাঁধে। যদিও এই বিতর্কে অমৃত্য সেনের পক্ষেই রয়েছে আশ্রমিক ও বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থীদের একাংশ।

গত বৃহস্পতিবার, অমর্ত্য সেনের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে দেখা করতে যান বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থী-অধ্যাপকেরা। উপাচার্যের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে একাধিক নালিশ করেন তারা। এরপরই বিশ্বভারতীর শিক্ষার মান থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের সাসপেণ্ড প্রসঙ্গে উষ্মা প্রকাশ করেন অমর্ত্য সেন। গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে জমি বিতর্ক নিয়ে তার বিরুদ্ধে ও ওঠা সমস্ত  অভিযোগের উত্তর দেন তিনি। অমর্ত্য সেন বলেন ‘আইনজীবীর চিঠি নিশ্চয়ই যাবে’। মজার ছলে তার অভিযোগ ছিল ‘দিল্লির কিছু লোকজন আছে যারা আমাকে পছন্দ করেন না।’ 

তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শুক্রবারই পুনরায় জমি ফেরত চেয়ে অমর্ত্য সেনকে চিঠি দেয় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনে অমর্ত্য সেনের আইনজীবীর উপস্থিতিতে জমি জরিপের প্রস্তাবও দেয় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, যা নিয়ে নিন্দার ঝড় ওঠে সর্বত্র।

বিতর্ক এতটাই চরমে ওঠে যে অমর্ত্য সেনকে তার নোবেল পুরস্কার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। শুক্রবারই তার দাবী ছিল ‘অমর্ত্য সেন নোবেল পাননি। অথচ উনি নিজেকে দাবি করেন নোবেলজয়ী। আমি ওনাকে সম্মান করি। তাই বলছি, উনি যাতে এই বিষয়ে আলোচনার মধ্য দিতে সমস্যার সমাধান করেন।’ উপাচার্যের যুক্তি আলফ্রেড নোবেলের উইলে অর্থনীতিতে নোবেলের কথা ছিল না তাই অমর্ত্য সেন কে নোবেল প্রাপক বলা যায় না। 
এমনকি, অমর্ত্য সেন যে অন্যায়টা করেছেন সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো উচিত বলেও নিশানা করেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য।

এরপর পাল্টা উপাচার্যকে নিশানা করেন অমর্ত্য সেন। জমি বিতর্ক নিয়ে শুক্রবার শান্তিনিকেতনে নিজের বাড়িতে বসে অমর্ত্য সেন জানান ‘আমি আদালতে সত্যিই যাইনি। তবে ভয়ে আদালতে যাচ্ছি না, এটা ভেবে থাকলে উপাচার্যের চিন্তাশক্তি নিয়ে ভাববার কারণ আছে। কেন জমি নিয়ে এই কাণ্ড হচ্ছে, কার মাথায় কী কাজ করছে, তা আমি বলতে পারব না।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপাচার্যের সঙ্গে কেউ কেন আলোচনায় বসেন না, সেটা ওনার ভাবা উচিত।’ 
 
‘নোবেল পদক প্রাপ্তি’ প্রসঙ্গে হেসে ভারতরত্নের জবাব ‘কেউ যদি দাবি করেন সেটা তার বিষয়। তিনি দাবি করতেই পারে, আমার কিছু বলার নেই।’

উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আমি খুব উৎসুক। তার সঙ্গে আলোচনা করলে আমার বুদ্ধির বিকাশ হবে। এই যে উনার ধারণা, সেই ধারণা নিয়ে চিন্তা করা দরকার, তার সঙ্গে লোকে কেন আলোচনা করতে যায় না।’

লেগেছে রাজনীতির রং

এদিকে এই ইস্যুতে লেগেছে রাজনীতির রং। ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি প্রত্যেকেই মুখ খুলেছে।  

বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের প্রশ্ন ‘জমি সম্পত্তির ওপর অমর্ত্য সেনের এত লোভ কেন?’ রাজ্যটির পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরে একটি দলীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘অমর্ত্য সেন যে নোবেল পাননি সেটা আগেই জানিয়েছিলাম। কারণ, অর্থনীতিতে নোবেল হয় না। উনাকে ঘিরে বিতর্ক শেষ হয় না। যেগুলো না হওয়াই ভালো। অমর্ত্য সেনের মতো লোক বাঙালির কাছে উদাহরণ। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি দখল করে নিয়েছেন বলে লোক অভিযোগ করবে সেটা কি সম্মানজনক? উনি নিয়েছেন কি না সেটাও পরিষ্কার করে বলছেন না কেন? যদি নিয়ে থাকেন তাহলে ছেড়ে দিন। জমি নিয়ে কি উনি উপরে যাবেন? এই বয়সে জমি সম্পত্তির ওপর মানুষের মোহ কেটে যায়। উনার এত মোহ কেন?’

বিজেপি সাংসদ স্বপন দাসগুপ্ত বলেন, ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশের জমি অমর্ত্য সেনের দখলে আছে। সেই কারণেই বিশ্বভারতী তাদের জমি উদ্ধার করার জন্যে তাকে নোটিশ দিয়েছে। সেটা নিয়ে রাজনীতি করার দরকার নেই। এটি একটি ব্যক্তির এবং অমর্ত্য সেনের ব্যক্তিগত মামলা।’

অন্যদিকে শনিবার হাওড়া পৌরসভায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জমি বিতর্ক ইস্যুতে মুখ খোলেন রাজ্যটির পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে পাগল বলে কটাক্ষ করে মন্ত্রী বলেন, ‘উপাচার্যকে এত হাইলাইটস করবেন না। উনি যা করছেন তাতে অমর্ত্য সেনের অপমান নয়, সারা বাংলার অপমান। আসলে অমর্ত্য সেন বিজেপির মতের সঙ্গে একমত হতে পারেননি বলে এই আচরণ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে খুশি করার জন্যই বিশ্বভারতীর উপাচার্য একাজ করছেন।’

রাজ্যের ক্ষুদ্র-কুঠির-মাঝারি শিল্প মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ দাবি তুলেছেন অমর্ত্য সেন নোবেল পেয়েছে কি না তা প্রমাণ করতে হবে বিশ্বভারতীর আচার্যকে। শনিবার মন্ত্রী বলেন, ‘আমি আচার্যের কাছে অনুরোধ করবো আগে এটাই প্রমাণ হোক যে, উনি নোবেল পেয়েছেন কি না। এটা তো লুকানো জিনিস না যে, নোবেল কর্তারা তার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে এসেছেন। অর্থনীতিতে নোবেল আছে কি নেই, সেটা আমাদের চেয়ে বিশ্বভারতীর আচার্য ভালো জানবেন। তাই আচার্যের কাছে এই দাবি জানাছি।’ 

নোবেল পুরস্কার ইস্যুতে সরব অভিনেতা বাদশা মৈত্র বলেন, ‘বাঙালিকে জাতি হিসেবে গোটা পৃথিবীতে যারা সম্মান এনে দিয়েছে, বাঙালির গৌরব বাড়িয়েছে, তাদের মধ্যে অমর্ত্য সেন একজন। তাই তিনি শুধু তো ব্যক্তি নন একটা জাতির প্রতিনিধি, সংস্কৃতির প্রতিনিধি। কম বেশি যারা অমর্ত্য সেনকে পড়েছেন তারা কমবেশি সকলেই জানেন। বর্তমান সময়ে কেবল ভারতেই নয়, গোটা বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক।’

অমর্ত্য সেনের বাড়িতে যেতে পারেন মমতা

এদিকে জমি বিতর্কের মাঝেই শোনা যাচ্ছে অমর্ত্য সেনের বাড়িতে যেতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তৃণমূল কংগ্রেস সূত্রের খবর দলীয় কর্মসূচি নিয়ে আগামী ৩১ জানুয়ারি তিনি বীরভূম সফরে যাচ্ছেন মমতা। আর ওই কর্মসূচির ফাঁকেই যেতে পারেন অমর্ত্য সেনের বাড়িতে। 

সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মমতা ব্যানার্জির সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন অমর্ত্য সেন। সেই আবহেই অমর্ত্য সেনের পাশে থাকার বার্তা দিতে পারেন মমতা। অন্তত এমনটাই বলছে সংশ্লিষ্ট মহল। 

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর