বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

কালের সাক্ষী ভবানীপুর জমিদারবাড়ি

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

কালের সাক্ষী ভবানীপুর জমিদারবাড়ি

অপরূপ সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম ভবানীপুর জমিদারবাড়ি। এখন কালের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক উজ্জ্বল ভাস্কর্যে। সৃষ্টি আর ধ্বংসে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত। আবার কারোর দায়িত্বহীনতায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক অতীত। আমরা বাঙালি, আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক অতীত। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। এসব ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ আমাদের সত্তায় আলোড়ন জাগায়। তেমনি আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক অতীত বহুল স্থান নওগাঁর আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী ভবানীপুর জমিদারবাড়িটি এলাকার মানুষের কাছে ভবানীপুর রাজবাড়ি বলেই বেশি পরিচিত। জানা গেছে, জমিদারবাড়িটি নওগাঁ শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ও আত্রাই উপজেলার শাহাগোলা ইউনিয়নের ভবানীপুর বাজার সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত। অযত্ন আর অবহেলায় এ জমিদারবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। জমিদার গির্জা শঙ্কর চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ছেলে প্রিয় শঙ্কর চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণ করে জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। জমিদার প্রিয় শঙ্কর চৌধুরীর স্ত্রীর নাম ছিল লাবণ্য প্রভা চৌধুরানী। তাদের ছিল ছয় ছেলে ও ছয় মেয়ে। জমিদার প্রিয় শঙ্কর চৌধুরীর আমলে জমিদারির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি ভবানীপুর জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজপ্রাসাদের পাশে অনেক পুকুর খনন করেন। ১৯১০ সালে জমিদার পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। স্কুলটির নামকরণ করা হয় গির্জা শঙ্কর চৌধুরীর নামকরণে ভবানীপুর জিএস উচ্চবিদ্যালয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর ১৯৬৮ সালের দিকে জমিদার প্রিয় শঙ্কর চৌধুরী সপরিবারে কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জমিদারের চতুর্থ ছেলে প্রতাপ শঙ্কর চৌধুরী দ্বিমত পোষণ করেন। পরে জমিদার প্রিয় শঙ্কর চৌধুরী ছেলেকে রেখেই কলকাতা পাড়ি জমান। জানা গেছে, প্রিয় শঙ্কর চৌধুরী হাতিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। বর্তমানে ছেলে অভিজিৎ চৌধুরী জমিদারবাড়ির এক প্রাসাদের জরাজীর্ণ ভবনে বসবাস করেন। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে সুবিশাল অট্টালিকা। এ রাজবাড়ির মূল ফটকের গেটে ছিল দুজন নেপালি প্রহরী। আজও প্রাসাদের দেয়াল দেখে বোঝা যায় রোমান কায়দায় স্তম্ভগুলো জমিদারদের রুচির পরিচয় বহন করে। জমিদারবাড়িতে সব মিলিয়ে কয়েকটি আঙিনা এবং অসংখ্য ঘর ছিল। প্রাসাদে ছিল তিনটি নিজস্ব দুর্গামন্দির, গোপীনাথ মন্দির ও বাসন্তী মন্দির। যেখানে পুরো বছরের জন্য একজন স্থায়ী পুরোহিত নিয়োজিত ছিলেন। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতিদিন। শোনা যেত শঙ্খের ধ্বনি যা কালের বিবর্তনে আজ জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। জমিদারবাড়িটিতে এখনো শান বাঁধানো একটি কুয়ার অস্তিত্ব রয়েছে। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো বড় একটি পুকুর যার পাশে ছিল গানবাড়ি নামক ভবন, যেখানে গানবাজনাসহ বিভিন্ন মনোরঞ্জনের কাজ চলত। গানবাড়ির সন্নিকটে ছিল একটি বৈঠকখানা যেখানে চলত বিচার-শালিস। বৈঠকখানার সামনে ছিল বড় ফুলের বাগান। বাগানবাড়ির চারপাশে রকমারি দেশি-বিদেশি ফুলের সমারোহ ও সুশোভন বাহারি পাতাবাহার দ্বারা পরিবেষ্টিত ফুলের বাগান। চারপাশ ছিল পাখির কলকাকলিতে মুখরিত, সৌম-শান্ত কোলাহলমুক্ত নানা বৈচিত্র্যের ফুলের বর্ণ ও গন্ধের সমারোহ। সেখানে আজ নির্মিত হয়েছে প্রতাপ শঙ্কর চৌধুরীর নামকরণে ভবানীপুর পিএস ল্যাবরেটরি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুল। বৈঠকখানার পশ্চিমে কিছু দূরে রয়েছে একটা ছোট পুকুর। যা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে, দিন দিন জমিদারবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে অনেকেরই বাড়ি তৈরি করার কথাও প্রচলিত রয়েছে। অবহেলা অযত্নে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদারবাড়িতে এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন দেখতে আসে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল অট্টালিকা। যেন কেউ দেখার নেই! বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ভবানীপুর জমিদারবাড়ি। দিন দিন বাড়িটি তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সংস্কার করা হলে জমিদারবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

সর্বশেষ খবর