রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

হঠাৎ কেন এত সড়ক দুর্ঘটনা

সাঈদুর রহমান রিমন

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে, নির্মম বলি হচ্ছে একের পর এক প্রাণ। অনেকে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ববরণ করছেন আজীবনের জন্য। শাস্তি পেতে হয় না বলেই চালক-হেলপারদের মধ্যে দিন দিনই অসতর্ক, অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা আর হতাহতের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চালকদের শাস্তি না পাওয়া, পুলিশের দায়িত্বহীনতা, বিআরটিএ’র দুর্নীতি সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দুর্ঘটনায় একজন মানুষের মৃত্যু মানেই একটি পরিবারের সারা জীবনের দীর্ঘশ্বাস। সড়কের এ করুণ পরিণতি থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না।

ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তারা আইন-কানুন মানছেন না বলে দিন দিন দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশে আইন আছে, রয়েছে শাস্তির বিধান। কিন্তু আইনের প্রয়োগ সন্তোষজনক নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত চালকদের সাজা ভোগের নজিরও দেখা যায় না। আইনের নানা ফাঁক-ফোকর আর পুলিশের মামলা জটিলতায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের তেমন ‘কিছুই হয় না’।

দুর্ঘটনার কান্না প্রতিদিনের চিত্র : দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের কান্না এখন দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতিদিনের চিত্রে পরিণত হয়েছে। কোনো কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, সড়কের সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকের মনোভাবের কারণেই বন্ধ হচ্ছে না সড়কে মৃত্যুর ঘটনা।

সম্প্রতি দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন যানবাহনের বেপরোয়া গতিকে। আর তা ঠেকাতে আইনের কঠোর প্রয়োগের কথা বললেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত বছর গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ গেছে ১১ জনের। অন্য গবেষণা সংস্থার মতে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে প্রায় ৮ হাজার মানুষ। গাড়ির ফিটনেস ও রাস্তায় গাড়ি চলাচলে তদারকি না থাকা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা।

তবু নেই শাস্তি : সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যাজনিত মামলায়ও সাজা ভোগের নজির খুব কম। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী গাড়ির চালক-মালিকরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ কারণে একশ্রেণির চালক-শ্রমিক দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২১০ দিনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২৪৫ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৩১১ জন শিশু, ৩০১ জন নারী। ২ হাজার ৮২টি দুর্ঘটনায় এ-সংখ্যক নিহতের ঘটনা ঘটে। অন্য একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে বলা হয়, ২০১৫ সালে সারা দেশে ছোট-বড় ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এত জানমালের ক্ষতিসাধনকারী দুর্ঘটনার কোনোটিতেই ঘাতক গাড়িচালক ও মালিকদের আইন-আদালতে শাস্তি পেতে হয়নি। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি কয়েক ঘণ্টার বেশি আটকেও রাখা যায়নি।

মারা গেলে ২০ হাজারেই মীমাংসা : পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে ‘মারা গেলে ২০ হাজার, আধমরায় ৫ হাজার’ কথাটি প্রবাদবাক্যের মতোই প্রচলিত আছে। এর অর্থ হচ্ছে, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মীমাংসার নামে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। আর মারাত্মক আহত কিংবা পঙ্গুত্ববরণকারীর জন্য এ বরাদ্দ সর্বোচ্চ ৫ হাজার।

সড়ক দুর্ঘটনার ৯ কারণ : পিপিআরসি ও ব্র্যাক সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে একটি যৌথ গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, একই সড়কে বিভিন্ন গতির যান চলাচল, সড়কের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, সড়কের নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতার অভাব ও পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ও অপ্রতুল শাস্তির বিধান। হাইওয়ে অ্যাক্ট অনুযায়ী মহাসড়কের উভয় পাশে ১০ মিটারের মধ্যে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো থাকা যাবে না। ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল রোড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় একটি টেকনিক্যাল রিপোর্ট তৈরি করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ মহাসড়ক দুই লেনের এবং সেগুলোয় কোনো সড়ক বিভাজন নেই। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতিমধ্যে জাতীয় মহাসড়কের ২২৭টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানের ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করা হয়েছে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৩১টি ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ১০টি স্থানে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, চার লেনে উন্নীত করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্ত, চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা ও ব্যাটারিচালিত অবৈধ যানবাহন বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর