বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পানির নিচে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে হাওরে

প্রতিদিন ডেস্ক

হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জের লাখো কৃষকের সারা বছরের আহার এখন পানির নিচে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। সিলেটের বিশ্বনাথে পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার প্রায় ১২০০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে হবিগঞ্জের বোরো ফসল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় বিভিন্ন হাওরের কাঁচা-পাকা ইরি-বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে হাওরে। কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর— সুনামগঞ্জ : পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে লাখো কৃষকের সারা বছরের আহার এখন পানির নিচে। প্রতিদিনই ডুবে চলছে একের পর এক বোরো ধান। এক ফসলি বোরোনির্ভর কৃষক জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে এখন দিশাহারা। গতকালও বাঁধ ভেঙে পানির নিচে তলিয়ে গেছে জেলার তিনটি বৃহৎ হাওরসহ মাঝারি ও ছোট আয়তনের অনেক হাওরের ফসল। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে পানির নিচে তলিয়ে গেছে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। বোরো চাষিরা বলেছেন, ৪০টি বড় হাওরের সবই এখন পানির নিচে। এদিকে, সুনামগঞ্জের প্রায় ৮০ ভাগ প্রান্তিক মানুষের মধ্যে এখন চরম হতাশা বিরাজ করছে। গত বছরের দেনার দায় থেকে বেরিয়ে আসার আগেইে এবারও ফসল তলিয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবিলা তাদের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষক। জেলাকে ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করা না হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে আগামী এক বছর অন্ধকার গন্তব্যের দিকে পা বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না তাদের। টানা চার দিন ফসলরক্ষা বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার কারণে এখন পর্যন্ত জেলার যে কটি হাওরের বাঁধ অক্ষত আছে সেগুলো টিকিয়ে রাখতে গতকালও হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছেন। গতকাল দুপুরে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো ঘুরে দেখেছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুট। তিনি বলেন, লাখো কৃষকের ফসলহানির পর সুনামগঞ্জকে দুর্গত জেলা ঘোষণা সময়ের দাবি। এই দাবিতে গতকাল দুপুর ১টায় জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে জেলা আইনজীবী সমিতি। শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ‘কৃষক বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’। জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে কৃষকের ফসলহানি হয়েছে এমন অভিযোগ এনে গতকাল বেলা ১১টায় উপজেলা পরিষদ চত্বরে কয়েক হাজার কৃষকের প্রতিবাদ সমাবেশে নেতৃত্বে দেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ। এ সময় জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা, পানি উন্নয়ন বোর্ডে বাঁধ নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি প্রদান এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপূরণসহ ১৪ দফা দাবি জানানো হয়। সদর আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা ও ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হোক। কিশোরগঞ্জ : পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে অনেক বাঁধ। তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক এলাকায় আধা-পাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। একমাত্র বোরো ফসল পানির নিচে চলে যাওয়ায় হাজার হাজার কৃষক পরিবারে এখন চলছে আহাজারি। ইটনা উপজেলার বিজয় বাঁধ, ধনপুর, করিমগঞ্জের পাঙাইয়া বাঁধ, মিঠামইনের ঢাকি, কেওয়ারজোড়, কাটখাল, অষ্টগ্রাম উপজেলার আবদুল্লাহপুর, কলমাসহ বিভিন্ন হাওরে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ বোরো জমি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রমতে, হাওরের ১০ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। বিশ্বনাথ (সিলেট) : বিশ্বনাথে পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার প্রায় ১২০০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট। বিপদসীমা অতিক্রম করেছে বাসিয়া নদীর পানি। প্লাবিত হয়েছে বেশির ভাগ মত্স্য খামার। সংকট দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাবারের। দৌলতপুর ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় হাওর চাউলধনীসহ প্রতিটি ইউনিয়নের সব কটি হাওরের বোরো ফসল রয়েছে পানির নিচে। হাওরের পাশে কৃষকদের অসহায়ের মতো ঘুরতে দেখা গেছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট। ধসে পড়েছে অনেকের কাঁচা ঘর। মত্স্য চাষিরা জানান, অনেক কষ্ট ও অর্থ ব্যয় করেও লাখ লাখ টাকার মাছ তারা ধরে রাখতে পারেননি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলী নূর রহমান বলেন, প্রায় ১২০০ হেক্টর বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনা : মাত্র ২০ লাখ টাকার মেরামত কাজ সময়মতো না হওয়ায় ভেসে গেল ১১ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমির ধান। পুরো জেলায় গতকাল সকাল পর্যন্ত ডুবেছে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমি। কাজের এক দিন পরই বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢোকে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মোহনগঞ্জ উপজেলার হাইজদা বাঁধ উপ-প্রকল্পের ৩১ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৮২ মিটার কাবিটা প্রকল্পের আওতায় ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয় নভেম্বরে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করাকে কেন্দ্র করে কাজ শুরু হয় ফেব্রুয়ারিতে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বর্ধিত করা হলেও কাজ শেষের এক দিন পর নির্মিত অংশ ছাড়াও আরও ১০ থেকে ২০ মিটার বাঁধের বেশি অংশ ভেঙে গেলে ডিঙাপোঁতাসহ বিভিন্ন হাওর তলিয়ে যায়। গতকাল সকাল পর্যন্ত ৬ উপজেলার বিভিন্ন হাওরের ১১ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমির কাঁচা ধান তলিয়ে যায়। এদিকে খালিয়াজুরীর কীর্তনখলা বাঁধটিরও শেষ রক্ষা হয়নি। এতে হাওরাঞ্চলের মোট ১৬ হাজার হেক্টর জমির কাঁচা ধান তলিয়ে যায়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গতকাল সকাল পর্যন্ত জেলার ৬ উপজেলার প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমির কাঁচা ধান তলিয়ে গেছে। হবিগঞ্জ : টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে হুমকির মুখে পড়েছে হবিগঞ্জের বোরো ফসল। আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কালনী, কুশিয়ারা ও ভেড়ামোহনা নদীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সেখানে বিপদসীমার ১৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর ১ ফুট পানি বাড়লেই বাঁধ তলিয়ে যাবে। ফলে কৈয়ারঢালা প্রকল্পের ১১ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাবে। এ বছর জেলার ১ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। কিন্তু টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫২০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বানিয়াচং উপজেলায় ৬৯০, লাখাই উপজেলায় ৬৫০, আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ৫৬০, হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় ৪৫০ ও নবীগঞ্জ উপজেলায় ১৭৪ হেক্টর। হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান, লাখাই উপজেলার হাওরগুলোয় পানি এসেছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলা থেকে এবং আজমিরীগঞ্জের কালনী-কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে মাহতাবপুরের ফসল বিনষ্ট হয়েছে। বানিয়াচং উপজেলার নোয়াগড় গ্রামের কৃষক রেণু মিয়া জানান, এই ফসল হলো তাদের একমাত্র অবলম্বন। যদি ফসল রক্ষা করা না যায় তাহলে সারা বছর চলা দায় হয়ে পড়বে। কৃষক আবদুর রহমান জানান, এই হাওরে তার ৮ একর জমি রয়েছে। এবার ধান পাকার আগেই জমি তলিয়ে গেছে। কৃষক ফারুক মিয়া জানান, ধারদেনা করে অনেক কষ্টে ২ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। কিন্তু পানিতে পুরো হাওরই তলিয়ে গেছে। কৃষক সুমন মিয়া জানান, ধান সবে রং ধরেছে। এর মাঝেই তলিয়ে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নাসিরনগর উপজেলার বিভিন্ন হাওরের কাঁচা-পাকা ইরি-বোরো জমির ফসল তলিয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ২০০ হেক্টর ইরি-বোরো জমির ধান পানির নিচে রয়েছে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের মেদির হাওর, গোয়ালনগর ইউনিয়নের উত্তর গাভের হাওর, পাতলপুর হাওর, ভলাকুট ইউনিয়নের লঙ্গণ হাওর ও চাতলপাড় ইউনিয়নের বাগাইয়া হাওরে বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবিয়ে কৃষক কাঁচা-পাকা ধান কাঁটছে। একমাত্র বোরো ধান হারিয়ে কৃষক পরিবারে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। এদিকে, শনিবার দুপুরে অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়া ইউনিয়নের লাইড়া গ্রামের কৃষক শহীদ মিয়া (৩২) নৌকা দিয়ে চাতলপাড় বাজারে আসার পথে নৌকা ডুবে যায়। চার দিনেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিছুজ্জামান জানান, ২০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়েছে। তবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে।

 

সর্বশেষ খবর