মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৩৯

খুনে জড়িতরা স্কুলছাত্র

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনে জড়িতরা স্কুলছাত্র

পাশের বাড়িতে পিকনিক। এই খুশি ছড়িয়ে পড়েছিল শিহাবদের বাসায়ও। পিকনিকের উত্তেজনায় শিহাবের ঘুম আসছিল না। বাবা-মা তাকে বকাঝকা দেওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু খুব ভোরে তার ঠিকই ঘুম ভাঙে। তার মা তাকে জামাকাপড় পরিয়ে দেয়। মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরাটাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’ বাবা তাকে পাশের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। শিহাবকে মা বলে দিয়েছিলেন, সে যেন বিকালেই বাসায় চলে আসে। সেই বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যার পর আসে রাত। পরদিন নতুন সূর্যের দেখা মেলে। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু শিহাব! আর কোনো দিনই বাবা-মায়ের বুকে ফিরে আসেনি।

৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। বার বার টেলিফোনে মুক্তিপণের টাকার দাবি করতে থাকে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু এক সপ্তাহ পর শিহাবের লাশ পাওয়া যায় একটি সেপটিক ট্যাংকের ভিতর। তত দিনে লাশ পচে গলে গন্ধ বেরোয়।

২০১৩ সালের শুরুতে সংঘটিত এই অপহরণ ও খুনের ঘটনায় দুটি শিশুসহ চারজন জড়িত ছিল। এরা প্রত্যেকেই স্কুলছাত্র। ঘটনাটি কুমিল্লার। পুলিশ খুনের সঙ্গে জড়িত চারজনকেই গ্রেফতার করে। আদালত দুজনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। বাকি দুই শিশু আসামিকে শিশু আদালত ১০ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করে। কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের রত্নাবতী গ্রামের নজরুল ইসলামের শিশু সন্তান রাশেদুল ইসলাম শিহাব। স্থানীয় মাইলস্টোন বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি পাশের এক বাড়িতে পিকনিক করতে গিয়ে সে আর বাসায় ফিরে আসেনি। পরে তাকে না পেয়ে তার অভিভাবকরা কুমিল্লার স্থানীয় পত্রিকায় নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞাপন দেন। পরে অপহরণকারীরা শিহাবের বাবাকে মোবাইল ফোনে অপহরণের কথা উল্লেখ করে মুক্তিপণ বাবদ ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। পরবর্তীতে অপহরণকারীরা এসএমএস পাঠিয়ে আরও ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এমনকি তারা অপহরণের সত্যতা নিশ্চিত করতে শিহাবের জামাকাপড়ের ছবিও পাঠায়। শিহাবের বাবা-মা পাগলের মতো এখানে-সেখানে খোঁজ করতে থাকেন তাদের সন্তানকে। কিন্তু কোথাও মিলছিল না তাদের সন্তানকে। পুলিশ অপহরণকারীদের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং শুরু করে। স্থানীয় চার স্কুলছাত্রকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, অপহরণের রাতেই শিহাবকে জবাই করে হত্যা করে বাথরুমের ট্যাংকিতে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় শিহাবের বাবা নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে রবিন, নয়ন, ফয়সল, হৃদয়সহ চারজনকে আসামি করে ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওই বছরে চার আসামির মধ্যে রবিন ও নয়নের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে এবং ফয়সল ও হৃদয় কিশোর অপরাধী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কিশোর আদালতে পৃথক চার্জশিট দাখিল করেন। মামলায় দীর্ঘ শুনানি শেষে গেল বছর ১৬ নভেম্বর আসামি কুদ্দুছুর রহমান রবিন ও মাহে আলম নয়নকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ মামলার অন্য দুই আসামি শিশু হওয়ায় তাদের বিচার শিশু আদালতে সম্পন্ন হয়। আদালত এ দুজনকে ১০ বছর করে জেল দেয়। জেরার মুখে অপহরণকারীরা জানায়, শিহাবকে অপহরণ করে নয়ন ও ফয়সল। কান্নাকাটি শুরু করলে তারা চাদর দিয়ে শিহাবের চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে, এতে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে অপহরণকারীরা শিহাবকে রত্নাবতী গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত বাথরুমের ট্যাংকির ভিতর ফেলে দিয়ে চলে আসে। এরপর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় রবিন ও হৃদয়। এ সময় ট্যাংকিতে শিহাব নড়াচড়া করছে দেখে রবিন দোকান থেকে ব্লেড কিনে এনে তাকে জবাই করে। তারপর হৃদয় তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বাড়ি থেকে ছুরি এনে আবারও তার গলায় ছুরি চালায়। পরে অপহরণকারী চক্র তার পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তিন দিন পর পুলিশ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যমতে শিহাবের লাশ উদ্ধার করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর