বুধবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ক্যান্সার ইনস্টিটিউট

মেঝেতে চিকিৎসা মেঝেতেই মৃত্যু

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মেঝেতে চিকিৎসা মেঝেতেই মৃত্যু

তানভীরের বয়স সাত বছর পাঁচ মাস। ছোট্ট শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। এ পর্যন্ত ওকে পাঁচটি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। আরেকটি কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য সিলেট থেকে রাত ১১টায় মুমূর্ষু সন্তানকে নিয়ে এলেও জোটেনি হাসপাতালের বিছানা। হাসপাতালের বাইরের সিঁড়িতে বসে মায়ের শরীরের সঙ্গে লেপটে রয়েছে শিশুটি।

তানভীরের মা স্বর্ণা আক্তার বলেন, ‘ঢাকায় হোটেলে থেকে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই আমাদের। ওর বাবা দিনমজুরের কাজ করে। অনেক চেষ্টা করেও হাসপাতালে বিছানার ব্যবস্থা করতে পারিনি। কেমোথেরাপি দিতে এসে হাসপাতাল মিলনায়তনের বারান্দায় থাকি। কিন্তু এবার অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় সেখানেও জায়গা পাইনি। তানভীরের বাবা গেছে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে। ঘুমানোর মতো জায়গা না পেলে ছেলেটাকে নিয়ে এই শীতের রাত হাসপাতালের সিঁড়িতেই কাটাতে হবে।’ এই অসহায় অবস্থা শুধু তানভীরের নয়, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ রোগীর। হাসপাতালের মেঝেতে রোগীদের থাকা নিষিদ্ধ করার পর মিলনায়তনের বারান্দা ও সামনের আঙিনায় খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই গড়ে তুলেছেন ক্যান্সারে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীরা। বারান্দার মেঝেতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৩৫ জন রোগী আছেন। এদের অনেকেই মাসখানেক থেকে শুরু করে এক বছর ধরেও আছেন।

এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ রোগীকে কেমোথেরাপি ও ৩৫০ থেকে ৪০০ জনের মতো রোগীকে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। শয্যা সংকটের কারণে সব রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই হাঁটাচলা করতে পারেন এমন রোগীকে থেরাপি দেওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। রোগীরা নিজ দায়িত্বে যে কোনো জায়গা থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যান।

গ্লোবোক্যান ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সার আক্রান্ত হয় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদ- অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার কেন্দ্র দরকার। এ হিসাবে বাংলাদেশে ক্যান্সার কেন্দ্রের প্রয়োজন ১৬০টি। এর বিপরীতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে রয়েছে মাত্র ১৮টি। এসব ক্যান্সার কেন্দ্রও আবার রাজধানীকেন্দ্রিক। তাই চিকিৎসার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগী ও তাদের স্বজনদের ঢাকায় আসতে হয়। সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা কম হওয়ায় অধিকাংশ রোগীকে বাইরে থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। হাসপাতাল মিলনায়তনের বারান্দায় এক বছরের বেশি সময় ধরে রয়েছেন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রিজিয়া বেগম। পলিথিনের ওপর একটা পাতলা কম্বল পাতা বিছানা। পাশে ব্যাগে রাখা কিছু কাপড় আর থালাবাসন। রিজিয়া বেগম বলেন, ‘রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির পর হাসপাতালে ভর্তি থাকার সুযোগ নেই। একবার রেডিওথেরাপি দিলে মাঝে ১০-১২ দিনের বিরতি থাকে। প্রথম দিকে বাড়ি থেকে আসতাম কিন্তু অনেক খরচ পড়ে যায়। ঢাকায় ভাড়া দিয়ে বাসা নিয়ে থাকা কিংবা হোটেলে থাকার সামর্থ্য আমার নাই। এজন্য বারান্দাতেই থাকি।’ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আমার পাশের বিছানায় তিন মাস ধরে ছিলেন মাদারীপুরের শরীফা নামের এক রোগী। গত সপ্তাহে চোখের সামনেই মারা গেলেন। আমার রুহ্-ও একদিন হয়তো এই মেঝেতেই চলে যাবে।’ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ইপিডেমিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীকেন্দ্রিক সেবা হওয়ার কারণে রোগীদের এ অসহায় অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। রোগীর সংখ্যার অনুপাতে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা খুবই কম। আটটি বিভাগীয় শহরে পরিপূর্ণ ক্যান্সার সেবার ব্যবস্থা করতে পারলে এ দুরবস্থা কমবে। কিন্তু মেডিকেল কলেজগুলোয় শুধু রেডিওলজি বিভাগ খুলে দিলে ভুল সিদ্ধান্ত হবে। এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটা ইউনিট দিয়ে তো আর ক্যান্সারের চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। শুধু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিলে হবে না প্রতিরোধের জন্য স্ক্রিনিং সেবা বাড়াতে হবে। আটটি বিভাগে পরিপূর্ণ বিভাগ খুলতে ৮০০ কোটি টাকা লাগবে। সরকার যদি একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে পাঁচ বছরে ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা আমূল বদলে ফেলা যাবে।’

সর্বশেষ খবর