মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘাতক সেলফি

মির্জা মেহেদী তমাল

ঘাতক সেলফি

পরিবার নিয়ে আনন্দ নৌভ্রমণ করছিলেন তারা। গোধূলিবেলায় নৌকার ছইয়ের ওপর সেলফি তুলছিলেন তিন নারী। সেলফি তোলার সময় তারা খেয়াল করেননি নৌকার ছই কতটুকু মজবুত। যা হওয়ার তাই হলো। ছই ভেঙে গেল। অন্যসব যাত্রী হৈচৈ করলে হুড়মুড় করে নৌকা কাত হয়ে যায়। মুহূর্তেই তলিয়ে যায় নৌকাটি। নৌকায় ছিল ২২ জন। ১৭ জন জীবিত উদ্ধার হলেও তিন নারীসহ পাঁচজনের মিলল লাশ। রাজশাহীর চলনবিলের চাটমোহর উপজেলার হাণ্ডিয়াল পাইকপাড়া ঘাট এলাকার ঘটনা এটি। হাফিজুর রহমান তার দুই মেয়েকে নিয়ে সেলফি তুলতে নরসিংদীর পুরানপাড়া রেলসেতুর কাছে যান। রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিলেন। এ সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস ধেয়ে আসছিল। তারা তিনজনই ছিলেন সেলফি তোলায় ব্যস্ত। চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় তিনজনই ছিটকে পড়েন। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। এমন ঘটনা ঘটছে সারা দেশে, অহরহ। এর পরও মানুষ সচেতন হচ্ছে না। সেলফি তুলেই যাচ্ছে যত বিপজ্জনক পরিস্থিতি থাকুক না কেন। যেখানে-সেখানে হামেশা সেলফি তোলায় ব্যস্ত একশ্রেণির মানুষ। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কাজটি করে থাকে তারা। কখনো কখনো ঘটে দুর্ঘটনা। অনেক সময় নিজ দায়িত্বের কথা ভুলে মানুষ ডুবে থাকছে সেলফি তোলায়। সম্প্রতি বনানীতে একটি ভবনে আগুনের ঘটনায় সাধারণ মানুষ উদ্ধারকারীদের কাজে সমস্যা করে নিজেরা সেলফি তুলছিল; যা নিয়ে তোলপাড় হয় সারা দেশে। তবু বিরতি নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেলফি নিয়ে ঘটছে মজার মজার ঘটনা। আর তাই তো সেলফি তোলাকে একধরনের মানসিক রোগ বলেছেন একদল গবেষক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাস্তাঘাটে, যে কোনো মুহূর্তে, বন্ধুদের আড্ডা, বিয়েবাড়িসহ বিভিন্ন উপলক্ষে সেলফি তোলাটা এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। একধরনের অবসেসিভ ডিজঅর্ডারের কারণেই এ সেলফি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তা এমন পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যে, বিপজ্জনক সেলফি তোলা থেকেও বিরত থাকছে না তারা। করুণ মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। সেলফি হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর। জানা যায়, সেলফি তোলা যে একরকমের রোগ তা অনস্বীকার্য। নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটি ও তামিলনাড়ুর থিয়াগারাজার স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের গবেষকরা যৌথভাবে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ভারতকে। কারণ ভারতে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যায়ও ভারত এগিয়ে। ফলে ভারতের জনগণের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, রোগের নাম সেলফাইটিস। তার বেশ কয়েকটি ধাপও আছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, দিনে যারা তিনটি সেলফি তোলেন এবং প্রতিটিই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন, তারা অ্যাকিউট সেলফাইটিসে আক্রান্ত। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় যদি কেউ সেলফি তোলেন, আর তা পোস্ট করতে থাকেন, তবে তিনি ক্রনিক সেলফাইটিসে আক্রান্ত। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীরা দিনে অন্তত ছয়টি করে সেলফি তোলেন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, সামাজিকভাবে নিজেকে সংযুক্ত রাখা, নিজের পরিপার্শ্বের রেকর্ড রাখার তাগিদেই এ কাজ করেন। অনেকে আবার মুড ভালো রাখার উপায় হিসেবেও দেখেন। আসলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাই ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে সেলফির দিকে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর