সোমবার, ১৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাড়ছে শিশুদের ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও মাহবুব মমতাজী

বাড়ছে শিশুদের ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা

টিভির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার, ট্যাব ও মোবাইল ফোন। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনে আসক্তি শিশুর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন চোখের চিকিৎসায় দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা। তারা শিশুদের চোখে সমস্যার তিনটি কারণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে কোনো কোনো শিশু চোখে সমস্যা নিয়েই জন্মায়। ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত কারণে শিশু রাতকানা রোগে ভুগতে পারে, এমনকি অন্ধও হয়ে যেতে পারে। আর তৃতীয়ত, স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে শিশুরা চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না। সারা দেশে ঠিক কত শিশু এমন সমস্যায় ভুগছে এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো গবেষণা নেই। জানা গেছে, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে মাসে গড়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিশু আসে। এদের ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। বেসরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশ আই হসপিটালের তথ্যও একই। এই হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতে আসা ৭০ শতাংশ শিশু একই রোগে ভুগছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

ডাক্তারি ভাষায় রোগটিকে বলা হয় মাইয়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। আরও সুনির্দিষ্টভাবে এই রোগকে বলা হচ্ছে ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রম’। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের প্রকাশ করা এক তথ্যে জানা গেছে, প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার শিশু নতুনভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন শিশু প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করছে। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক শিশু যেমন প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট জগতে আসছে, একই সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার তাদের জন্য নানা ঝুঁকি তৈরি করছে। শিশুদের চোখের সমস্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও যে কোনো চশমার দোকানে শিশুদের জন্য গোলাপি, বেগুনি, নীল, সাদার ওপর ছোপছাপ করা বা হ্যালো কিটি (কার্টুনের চরিত্র) নকশা করা চশমার সমাহার বলে দেয় যে কত শিশুর চশমা লাগছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শোভানা আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্ক্রিনের কারণে শিশুদের সমস্যা বাড়ছে। তারা কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোনে বেশি ঝুঁকছে। শুধু শহরের শিশুরা নয়, গ্রামের শিশুরাও এখন চোখের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া মাদ্রাসার শিশুদের সমস্যাটা ভিন্ন। তাদেরটা মোবাইল ব্যবহারের জন্য নয়, বরং একনিষ্ঠভাবে নিচের দিকে কিতাব পড়ার কারণে তারা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর আগে ২০১৩ সালে ল্যানসেট এশিয়ায় ক্ষীণদৃষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ ছেপেছিল। ওই প্রবন্ধের লেখক ও গবেষক অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়ান জি মরগ্যানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, এশিয়ার দেশগুলোয় গত ৪০ বছরে ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়েছে। ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০ বছর বয়সী তরুণদের ১৮ শতাংশ ক্ষীণদৃষ্টিতে ভুগত। ২০১১ সালে এ সংখ্যা ৯৬ শতাংশে দাঁড়ায়। হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে এ সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ।

চক্ষুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্ষিগোলকের আকৃতি যখন স্বাভাবিক থাকে, তখন প্রথমেই আলো গিয়ে পড়ে মানুষের চোখের মণিতে (কর্নিয়া)। সেখান থেকে মণির ভিতরের আরও কালো যে অংশ, সেই নয়নতারা (পিউপিল) ও লেন্স হয়ে আলো অক্ষিপটে (রেটিনা) পৌঁছায়। অক্ষিপটের কোষগুলো উদ্দীপিত হয়ে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠালে তবেই মানুষ দেখতে পায়। লম্বা সময় চোখের খুব সামনে রেখে শিশুরা যখন কম্পিউটার, ট্যাব বা মোবাইল ফোনে গেমস খেলে, তখন চোখ বিশ্রাম পায় না। চোখের মাংসপেশিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। এ কারণে শিশুর চোখ আর চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না।

মাত্র সাত বছর বয়স থেকেই মাইয়োপিয়া বা চোখের ক্ষীণদৃষ্টি রোগে আক্রান্ত হয় রাজধানীর মণিপুর স্কুল ও কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাবাব। ১০ বছর বয়সে শাবাবের সমস্যা ছিল দূরের বস্তু ঝাপসা সে দেখত। এ সমস্যা নিয়ে মাঝেমধ্যেই তাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। চিকিৎসকেরা তার অভিভাবককে জানান, দিনের বেশির ভাগ সময় স্মার্টফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার কারণে ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে সে। শাবাব বলে, ‘ফোনে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখি, আর গেমস খেলি।’ দেশে শাবাবের মতো শিশুদের ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এক দশক আগেও ৮ থেকে ১০ বছরের শিশুদের এমন অবস্থা দেখা না গেলেও বর্তমানে স্মার্টফোন আর ট্যাবের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে শিশুদেরও বর্তমানে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামের চেয়ে শহরের শিশুদের চোখে এ সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। এর কারণ অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার করা। এক দশক আগেও ৮ থেকে ৯ বছরের পর শিশুরা আক্রান্ত হলেও বর্তমানে দুই থেকে তিন বছর বয়সেই শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে মায়োপিয়ায়। প্রথম থেকেই শিশুদের মোবাইল, ট্যাব ও ভিডিও গেমসের প্রতি চরম আসক্তি তাদের চোখের ছানি, রেটিনার নানা সমস্যাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সর্বশেষ খবর