রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভূমধ্যসাগরে বিজয় পতাকা

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে

ভূমধ্যসাগরে বিজয় পতাকা

চার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ছয় হাজার নটিক্যাল মাইল পেরিয়ে নয় বছর আগে জাতিসংঘের হয়ে ভূমধ্যসাগরে এসে নোঙর করেছিল বাংলার নৌবাহিনীর দুই যুদ্ধ জাহাজ। সেই থেকে দিনরাত একাকার করে বাংলাদেশের নাবিকরা লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও চোরাচালান রোধ, তাদের নিরাপত্তা ও সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় কাজ করছে। ভূমধ্যসাগরের উত্তাল জলরাশিতে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়ের মাস্তুলে উড়ছে বাংলার গৌরবের লাল সবুজ পতাকা। গত নয় বছর ধরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শত শত নাবিক জীবন ঝুঁকি নিয়ে অপূর্ব সুন্দর এই আরব দেশটির সহায়তা করে আসছে। ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে দেশের জন্য বয়ে আনছেন বিরল সম্মান ও মর্যাদা এবং বৈদেশিক মুদ্রা। জাতিসংঘ মেরিটাইম টাস্কফোর্সের (এমটিএফ) আওতায় ২০১০ সাল থেকে লেবাননে দুটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ জয় করছে নৌবাহিনীর নাবিকরা। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছে একটি জাহাজ বিএনএস বিজয়, ১১৬ জন নাবিক ও কর্মকর্তা নিয়ে। গতকাল পর্যন্ত বিএনএস বিজয় লেবাননে ৩৩৫ দিন অতিক্রম করেছে। এই সময়ে জাহাজটি নাবিক নিয়ে ২১০ দিন ছিল গভীর সমুদ্রে। এ সময়ে ৪৩টি ট্রিপের মাধ্যমে ৮৭২টি জাহাজকে তল্লাশি চালিয়েছে বিজয়। গতকাল ভোর ৭টা থেকে গভীর ভূমধ্যসাগরে দিনভর কাটিয়ে যখন বৈরুত বন্দরে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যার সামান্য বাকি। সমুদ্রের দুই হাজার ৫০ মিটার গভীরতায় ছুটে বেড়ায় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়। মাইলের হিসাবে তা দুই মাইলেরও বেশি গভীর। স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে এই ভূমধ্যসাগরেই প্রতি বছর শত শত হতভাগ্য বাংলাদেশি প্রাণ হারান। গত মে মাসেই তিউনিশিয়ার উপকূলে উত্তাল সমুদ্রে ৩৭ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারান। সেই দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের একাংশ পাহারায় নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অকূতভয় নাবিকরা শীতের মৌসুমে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে লড়ে দায়িত্ব পালন করে। দুপুরের খাবারের সময় জাহাজের কমান্ডিং অফিসার ও বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম নজরুল ইসলাম বলেন, আপনাদের ভাগ্য ভালো, সামারে এসেছেন। এখানে সামারে সমুদ্র শান্ত থাকে। শীত মৌসুমে এলে আপনাদের জাহাজে আনতে পারতাম না। তখন এভাবে ড্রয়িং রুমের মতো বসে একসঙ্গে খাবার খেতে পারতাম না। কয়েকবার গড়াগড়ি খেতে হতো। জানা গেছে, শীতে ভূমধ্যসাগর ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। সর্বক্ষণ দুলতে থাকে জাহাজ। সি সিকনেসের কারণে নাবিকরা খেতে পারে না। অনেকেই বমি করে দেয়। রান্নাও ঠিকমতো করা যায় না। জাহাজের অতিরিক্ত দুলুনির কারণে রান্নার সময় চুলা থেকে ভাত, তরকারি গড়িয়ে পড়ে যায়। জাহাজে সকালের নাস্তা সেরে আমরা যখন যাত্রা শুরু করি তার আগে জাহাজের সিও সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর তাঁর দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। ক্যাপ্টেন এম নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের নির্ধারিত ভাগ করা জোনে যত ধরনের ট্রলার, সেলিং বোট, ইয়ট চলাচল করে তাদের সঙ্গে আমরা ভয়েস কমিউনিকেশনের মাধ্যমে যোগাযোগ করি। আমরা তাদের নাম ধরে জানতে চাই, তারা কোন পোর্ট থেকে এসেছে, কোন পোর্টে যাবে, ক্রু কয়জন আছে, কী বহন করছে এসব তথ্য জানার পর তাদের পারমিশন দেই। যদি তথ্যের কোনো ব্যত্যয় পাওয়া যায় তাহলে আমরা আমাদের নির্ধারিত ইন্সপেকশন টিম পাঠিয়ে তল্লাশি চালাই। আমাদের জাহাজে যে রাডার আছে তা দিয়ে আমরা ১৬০ মাইল দূরের বস্তুকেও শনাক্ত করতে পারি। স্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারি ১০০ মাইল দূরের বস্তুকে। কোনো জাহাজ যদি কোনো অগ্রিম তথ্য ছাড়াই সন্দেহজনক কোনো আচরণ করে তাহলে তাদের আমরা লেবানিজ নেভির কাছে হস্তান্তর করি। তিনি বলেন, আমাদের আরেকটি কাজ লেবানিজ নাবিক ও অফিসারদের ট্রেনিং দিয়ে সক্ষম করে তোলা। আমরা এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি লেবানিজ নাবিককে ট্রেনিং দিয়েছি। গত এক বছরে প্রায় ৯০০ জাহাজকে তল্লাশি করেছি। গত নয় বছরে আমাদের জাহাজগুলো ১০ হাজারের বেশি শিপ তল্লাশি করেছে। কিছুক্ষণ পর লেবানন নেভির একজন লিয়াজোঁ অফিসার আমাদের জাহাজে আসবে। আগামীকাল তাদের তিনজন ক্যাডেট আসবে। তারা এখানে কদিন থাকবে, ট্রেনিং নেবে। তিনি বলেন, আমরা একটু আগে জার্মান নেভির সঙ্গে একটি এক্সারসাইজ করেছি। এটাকে রিফ্রেসমেন্ট এট দ্য সি বলে। সমুদ্রে যখন কোনো জাহাজের খাবার বা ফুয়েল ফুরিয়ে যায় তখন এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে সেটা ট্রান্সফার করতে পারি। এমন ট্রেনিং আমরা প্রায়ই করি, যাতে ক্রাইসিসের সময় পরস্পরকে সহায়তা করা যায়।

বৈদেশিক মুদ্রা আয় : লেবাননে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করে গত এক বছরে ব্যানকন-৯ এর মাধ্যমে প্রায় ৬৩ লাখ ২৬ হাজার ২৯৪ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে জাহাজের জন্য নির্ধারিত ৩৮ লাখ ৬৮ হাজার ২৭০ ডলার, নাবিকদের জন্য ১৯ লাখ ১৯ হাজার ৯৪০ ডলার এবং শিপ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪ ডলার। এর আগে ব্যানকন-৮ ৭৯ লাখ ৬৫ হাজার ৭২৬ ডলার আয় করে। তখন দুটি জাহাজ লেবাননে নিয়োজিত ছিল। যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে সমুদ্রপথ পাহারা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এদেশের মানুষের কাছে নতুন ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হয়েছে। লেবাননের বিভিন্ন দুর্যোগে সাহসিকতা দেখিয়েছে নৌবাহিনী। শীত মৌসুমে লেবাননের পরিবেশ থাকে দুর্যোগময়। এ সময় সাধারণ জলসীমার নিরাপত্তা বলতে কিছ্ ুথাকে না। উত্তাল সাগর নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই দুর্যোগে ইউনিফিলে অংশ নেওয়া উন্নত দেশের নৌ বাহিনী নিরাপদে আশ্রয়ে চলে গেলেও দায়িত্ব অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভূমধ্যসাগরের নিয়মিত টহল দিয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছে নৌবাহিনীর সদস্যরা। জাতিসংঘের পাশাপাশি লেবানন সরকারও এখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। লেবাননের রাস্তায়, শপিং মলে সর্বত্র বাংলাদেশি পরিচয়কে অত্যন্ত সমীহের চোখে দেখা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর