সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর পথে ওরা

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ঙ্কর পথে ওরা

কয়েক দিন আগের ঘটনা। রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকার একটি বাসার পার্কিং থেকে প্রাইভেট কার চুরি হয়ে যায়। ওই বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তা রেকর্ড হয়ে থাকে। ফুটেজ থেকে চোর শনাক্ত হয়। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত শুরু করে। গাড়ি চোর গ্রেফতারে গোয়েন্দারা মাঠে নামে। গাড়ি চুরির ফুটেজ পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও নানা তথ্যের পর চোর সম্পর্কে জানতে পেরে পুলিশ হতবাক। চোর পেশাদার নয়। সামাজিক-আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি পরিবারের সন্তান সে। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তবে মাদকাসক্ত। ডার্টি পিল ইয়াবা সেবন করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। একাধিকবার মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিছুদিন মাদক থেকে দূরে থাকলেও আবার জড়িয়ে পড়েন। মা-বাবা টাকা না দিলে বাসায় ভাংচুর করেন। কখনো কখনো বাসা থেকে চুরি করে মাদকের টাকা সংগ্রহ করতেন। ইয়াবা সেবন করতে গিয়ে পরিচয় হয় উত্তরা এলাকার গাড়ি চোর চক্রের হোতা কবিরের সঙ্গে।

ওই তরুণকে ৫০টি ইয়াবার বিনিময়ে পার্কিংয়ে থাকা গাড়ি চুরির টার্গেট দেওয়া হয়। তার হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি ‘মাস্টার কি’। টার্গেট অনুসারেই ওই তরুণ ‘মাস্টার কি’ ব্যবহার করে গাড়িটি চুরি করেন। একইভাবে উত্তরা এলাকাতেই আরেকটি গাড়ি চুরির টার্গেট দেওয়া হয় এর মতো আরেক তরুণকে। ইয়াবার বিনিময়ে ওই গাড়ি চুরি করতে গেলে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় সেই তরুণ। বিষয়টি সামাজিকভাবে শেষ হলেও খবর পৌঁছে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এ চক্রটি মূলত মাদক ব্যবসায়ী। নানা কৌশলে গাড়ি চুরি করে ওই গাড়িগুলো মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহার করে চক্রটি। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, এ ধরনের অর্ধশত কিশোর তরুণকে নানা ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানো হয়েছে।

কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হন নিরীহ রিকশাচালক রাজু। নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে ইয়াবা। তারা ইয়াবা ব্যবসায়ী মফিজকে খুন করতে গিয়ে ভুলবশত খুন করে রিকশাচালক রাজুকে। নওগাঁর নিয়ামতপুরে নেশার টাকা না পেয়ে মাদকাসক্ত ছেলের লাঠির আঘাতে নিহত হন পিতা আবদুল হামিদ। গতকাল যাত্রাবাড়ীতে কিশোরের হাতে খুন হয় আরেক কিশোর। এসব ঘটনার নেপথ্যেও মাদক। গোয়েন্দারা জানায়, ইয়াবা আসক্তির কারণে অনেকেই আর্থিক সংকটে ভুগে। টাকার অভাবে ইয়াবা কিনতে পারে না। আবার ইয়াবা ছাড়া তাদের চলেও না। মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ছিনতাই ডাকাতি খুনসহ নানা ভয়াবহ সব অপরাধে তারা জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন মামলায় আটক বা গ্রেফতারের পর আদালতের নির্দেশে সংশোধনের জন্য কিশোর অপরাধীদের পাঠানো হয় সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত গাজীপুর টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। কেন্দ্রের তথ্য মতে, সংশোধনাগারের ৩০০টি আসনের বিপরীতে এ মুহূর্তে ৬৭০ কিশোর-কিশোরীকে রাখা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই মাদক মামলার আসামি। এর বাইরে খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিংয়ের অভিযোগও রয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, কিশোর অপরাধের মূলে মাদক। বিশেষ করে পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামে ইয়াবার সয়লাব। বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে হাতের নাগালে থাকা এ ঘাতক ট্যাবলেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে কিশোর-তরুণরা। আর নেশার টাকা জোগাড় করতে প্রথমে পরিবারের সঙ্গে খারাপ আচরণ, পরবর্তী সময় সংঘবদ্ধভাবে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গ্রুপ সৃষ্টি করে চুরি-ছিনতাই-সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে, এমনকি খুন, ধর্ষণে জড়িয়ে পড়ছে উঠতি বয়সী ছেলেরা। সমাজের চিহ্নিত অপরাধীদের সহায়তায় একপর্যায়ে তারা মাদক বিক্রির ফাঁদেও পড়ে। এভাবে নষ্ট সমাজের কবলে পড়ে মাদকে ভ্রষ্ট হচ্ছে কিশোর-কিশোরী-তরুণরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘পরিবারিক শিক্ষা না পেয়ে কিংবা পরিবার শিক্ষিত না হওয়ায় প্রথমত কিশোররা বিপদগামী হচ্ছে। অনেকে গঠনমূলক ভিডিও দেখছে না। একপর্যায়ে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা মাদকসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন জায়গায় এসব গ্যাং চিহ্নিত হয়ে গেছে। এখন রাষ্ট্রকেই এগুলো নির্মূল করতে হবে। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র বা সংশোধনাগার দিয়ে কাজ হবে না। কেননা সেখানে যারা যায় তাদের বেশিরভাগই নির্যাতনের শিকার বা মারামারি করা অপরাধী।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর