বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ব্যস্ততা বাড়ছে বাংলাবান্ধায়

নেপাল ভুটান ও ভারত-বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছেন আসা-যাওয়া করছেন রোগী ও পর্যটক, তবু সমস্যার শেষ নেই

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, বাংলাবান্ধা (পঞ্চগড়) থেকে ফিরে

ব্যস্ততা বাড়ছে বাংলাবান্ধায়

বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। যাতায়াত বেড়েছে এ স্থলবন্দর দিয়ে। নেপাল, ভুটান ও ভারতের শিক্ষার্থীরা এ স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসছেন। আবার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও শিলিগুড়ি, দার্জিলিংসহ বিভিন্ন স্থানে পড়াশোনা করতে এ বন্দর ব্যবহার করছেন। অনেকে চিকিৎসা নিতেও এই স্থলবন্দর দিয়ে শিলিগুড়ি-দার্জিলিং যাচ্ছেন। আগের তুলনায় বেড়েছে আমদানি-রপ্তানিও। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্তে এই বন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্যটন খাতে বিপুল রাজস্ব আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। সুযোগ এসেছে এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও সংস্কৃতি আদান-প্রদানের। কিন্তু নানামুখী সমস্যা গ্রাস করেছে এই স্থলবন্দরকে। জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে শুরু হয় পূর্ণাঙ্গ ইমিগ্রেশন কার্যক্রম। ফলে চতুর্দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বপ্নের দুয়ার খুলে যায়। এর মধ্যে পাঁচ লক্ষাধিক যাত্রী এই ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করেছেন। দিন দিন যাত্রীর সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে মাসে গড়ে ১৬ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করছেন। ইতিমধ্যে এ বন্দরে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করছে। বাংলাবান্ধায় প্রথম শ্রেণির স্থলবন্দর হিসেবে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম পুরোদমে চালু হলে রাজস্ব আয় শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে নানা হয়রানির শিকারও হতে হয় পর্যটকদের। সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি স্থানে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয় তাদের। ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতে হয়। তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের। এ বন্দরে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্যটকদের নানামুখী সমস্যা দূর করতে আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করছি।’ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা ইছাহাক আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্থলবন্দরের উন্নয়নে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বন্দরটির সম্ভাবনা অনেক। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ বন্দরটিকে কাস্টমস হাউস হিসেবে ঘোষণা করা হবে এমন সম্ভাবনা উজ্জ্বল।’ জানা যায়, নেপাল, ভুটান ও ভারতের কয়েক শ শিক্ষার্থী বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ব্যবহার করে দিনাজপুরে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। আবার উত্তরবঙ্গের অনেকেই দার্জিলিং ও শিলিগুড়িতে চিকিৎসা নিতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্ধর ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থীও দার্জিলিংয়ে পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন এ বন্দর দিয়ে। দার্জিলিংয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরের শাহীদা খাতুন নামে এক নারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকায় যাতায়াত করতে বেশি টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া দার্জিলিংয়ে চিকিৎসাসেবার মানও ভালো। তাই চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সপরিবারেই তারা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে দার্জিলিং যান।

বাংলাবান্ধা বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ১৯৯৮ সালে নেপাল এবং ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে শুরু হয় ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যক্রম। এরপর ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ভুটান থেকে পাথর আমদানির মধ্য দিয়ে এই স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় প্রতিবেশী তিন দেশের সঙ্গে। বিপুল পরিমাণ রাজস্বও আয় হচ্ছে এই বন্দরে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে ৩৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে বন্দরটি আয় করে ৪৩ কোটি টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২০ কোটি টাকা। এ বছর অর্থবছর শেষ হওয়ার দুই মাস আগেই রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে নির্ধারিত ৩৬ কোটি ৭৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮১১ টাকা লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে আদায় হয়েছে ৪৮ কোটি ৫৬ লাখ ১৩ হাজার ৮১৬ টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার ৭০০ টাকা। গত জুন-জুলাই দুই মাসে আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ ১১ হাজার ৮২২ টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, এ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার সূচক পেরিয়ে যাবে।

এদিকে নানা সমস্যার কারণে এই বন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটকরাও বলছেন নানা সমস্যার কথা। এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে ১৯টি পণ্য আমদানির অনুমোদন থাকলেও শুধু পাথর আমদানি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অন্যান্য পণ্য আমদানিতে যে রকম সুবিধা দরকার, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেই সুবিধা দিচ্ছে না বলে এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অনেকে এও বলেন, এই বন্দরে এখনো আমদানি-রপ্তানির সুষম পরিবেশ তৈরি হয়নি। কয়েক বছর আগে কয়েকজন ব্যবসায়ী ফল আমদানি করলে স্থানীয় বাসিন্দারা ফলবাহী ট্রাকগুলো থেকে ফল লুটপাট করে। এজন্য অনেক ব্যবসায়ী নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। এ ব্যাপারে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, ব্যবসায়ীদের জন্য তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে প্রস্তুত। তবে অবকাঠামো আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন তারা।

জানা যায়, স্থলবন্দরে এখনো নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। মোবাইল নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় অনেককেই প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। সম্প্রতি টেলিটক নেটওয়ার্ক চালু করলেও বিদ্যুৎ না থাকলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। বন্দরটিতে ব্যাংক ব্যবস্থা না থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা এলসিও খুলতে পারছেন না। বন্দরের অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। সবে একটি পাকা ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সম্ভাবনাময় এই স্থলবন্দরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে পড়তে হচ্ছে অসহনীয় ভোগান্তিতে।

পর্যটকদের অভিযোগ, এ বন্দরে লাগেজ বহনের নেই কোনো ট্রলি। অসুস্থ রোগীদের জন্য নেই হুইলচেয়ার। আসা-যাওয়ার পথে নেই কোনো যাত্রী ছাউনি। বৃষ্টি হলে ভিজেই যাতায়াত করতে হয় এখানে। ভালো মানের আবাসিক হোটেলও নেই। গড়ে ওঠেনি রেস্টুরেন্ট। ডলার ইনডোর্স ও মানি এক্সচেঞ্জ সুবিধা না থাকায় ব্যাগেজ ক্লিয়ারেন্স নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয় যাত্রীদের। জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় ২০০ গজ ব্যাগেজ বহন করার সুবিধা না থাকায় দুর্ভোগ পোহান পর্যটকরা। জিরো পয়েন্টে যেটুকু সড়ক রয়েছে প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। ফলে যাত্রীদের উঁচু-নিচু পথ দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধায় সরাসরি যানবাহন নেই। এমনকি বাংলাবান্ধা থেকে দিনাজপুর ও রংপুর পর্যন্ত সরাসরি গাড়ি না থাকায় এই চেকপোস্ট ব্যবহারকারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এদিকে বিজিবির উদ্যোগে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় চোরাচালান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধে প্রশিক্ষিত কুকুরের সহায়তা নেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিজিবির আয়োজনে রবিবার অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, বডি ও ব্যাগ স্ক্যানার মেশিন স্থাপন এবং প্রশিক্ষিত কুকুরের ব্যবহারসহ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম শিগগিরই চালু করা হবে বলে জানানো হয়। বিজিবি বলছে, এতে যাত্রীদের হয়রানি যেমন কমবে, তেমনি অপরাধ ও চোরাচালানও রোধ করা সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর