বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বড়দের দ্বন্দ্বের বলি শিশুরা

মির্জা মেহেদী তমাল

বড়দের দ্বন্দ্বের বলি শিশুরা

পাঁচ বছরের ঘুমন্ত শিশু তুহিনকে তার বাবা কোলে তুলে নেয়। আর চাচা তুহিনকে গলা কেটে হত্যা করে। ফুটন্ত ফুলের মতো এই শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যার  পেছনের কারণও উদ্ঘাটন করেছে তদন্তকারী পুলিশরা। সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, মূলত নিজেকে বাঁচাতে এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশু তুহিনকে হত্যা করেছেন বাবা আবদুল বাছির। তুহিনকে হত্যায় বাবার সঙ্গে অংশ নিয়েছেন চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার। গত সপ্তাহের ঘটনা এটি। সাত বছরের শিশু হৃদয় মাঠে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরে তার লাশ বস্তাবন্দী অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে খুনি ইয়াসীনকে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায়, হৃদয়ের বাবার কাছে ইয়াসীন ১৫০০ টাকা পেতেন। কিন্তু টাকা দিতে গড়িমসি করায় শিশু হৃদয়কে খেলার মাঠ থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে গলা টিপে হত্যা করে।

সাইফুলের সঙ্গে তালাক হয়ে গেছে লাভলীর। সাইফুল আবারও বিয়ে করার প্রস্তুতি নেন। এ খবর জানতে পারে সাবেক স্ত্রী লাভলী। লাভলী বিষয়টি ভালোভাবে  নেননি। সাইফুলের প্রতি তার জেদ হয়। চিন্তা করতে থাকে কীভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায় সাইফুলের ওপর। ভাবতে ভাবতে তার মাথায় আসে আনিসের নাম। আনিস হলো সাইফুলের বড় ভাইয়ের ৭ বছরের শিশু সন্তান। লাভলী জানে আনিস স্কুলে যাওয়া-আসা করে। স্কুলের পথ থেকেই একদিন লাভলী তাকে তাদের বাসায় নিয়ে যান। আনিস লাভলীকে চাচি বলে ডাকে। মায়ের মতো জানে। কিন্তু লাভলী তাকে ভাত খাওয়ানোর কথা বলে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়। পরে গলা টিপে তাকে হত্যা করে লাশ ফেলে আসে। ঘটনাটি পাবনা জেলার আমিনপুর থানার খয়েরকান্দি (ঢালারচর) গ্রামের। রাজধানীর আদাবরে শিশু সামিউলকে হত্যার পর লাশ ফ্রিজে লুকিয়ে রেখেছিল তার মা নিজেই। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে সমাজ বিরুদ্ধ এক নষ্ট প্রেমের গল্প। পরকীয়ায় এমনভাবেই মত্ত ছিলেন সামিউলের মা আয়শা, সমাজ সংসার সন্তান লোকলজ্জা-কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তার সামনে। পরকীয়ার বাধা হয়ে দাঁড়ানো নিজ শিশুসন্তানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা পর্যন্ত করেন। প্রেমিককে নিয়ে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নও ঘটান নিজ বাসাতেই। প্রেমিক বাক্কু আর আয়েশা যদিও গ্রেফতার হয় পুলিশের হাতে। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চারটি শিশু পাশের গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে আর বাড়ি  ফেরেনি। স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও শিশুদের সন্ধান পায়নি। থানায় জিডি-মামলাও করা হয়। কেউ মুক্তিপণ দাবি করে ফোনও করেনি। পরে তাদের লাশ মিলে মাটি খুঁড়ে। পরে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর তথ্য। স্থানীয় বাগাল ও তালুকদার বংশের লোকজনের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে খুন করা হয়েছে এই নিষ্পাপ চারটি শিশুকে। বড়দের রাগ-বিদ্বেষ, ক্ষোভ-বঞ্চনা, বিরহ-বিরোধ, মান-অভিমান, ঘৃণা-প্রত্যাখ্যানে এভাবেই নৃশংস বলি হচ্ছে শিশুরা। সন্তানের প্রতি চিরন্তন ভালোবাসা ভুলে কখনো মা-বাবাই হয়ে উঠছেন আপন সন্তানের হন্তারক। একের পর এক মর্মন্তুদ ঘটনা সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার স্বার্থহীন অটুট বন্ধনের মানবিক সম্পর্কের বিষয়টি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে কঠিন সত্যের সামনে। কখনো আবার সমাজ ও পরিবারের নানা বিরোধের জেরে ভয়ঙ্কর হত্যার শিকার হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। এমনকি অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে প্রায়ই শিশুদের সহজ টার্গেট বানাচ্ছে দাগি অপরাধীরা। দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিন নানা কারণে প্রাণ হারাচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। পরিসংখ্যান বলছে, এখন পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন একজন করে শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।  সংশ্লিষ্টদের অভিমত-পারিবারিক, সামাজিক সচেতনতার অভাব, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, পর্নোগ্রাফি, মানসিক অস্থিরতা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কুপ্রভাব, মাদকাসক্তি, অসাবধানতাবশত মারধর, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মানসিক অসুস্থতার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে। পুলিশ অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে কেবল মা-বাবার হাতেই প্রাণ গেছে দুই শতাধিক শিশুর। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে চাইলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন বাড়াতে হবে। অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করাতে হবে। শিশুর নিরাপত্তা ও সুন্দও শৈশব নিশ্চিত করার ব্যাপারে উদাসীনতা দূর করতে হবে। অপরাধীদের বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা জরুরি। শিশুদের মধ্যেও নানা বিষয়ে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করতে হবে। তারা মনে করেন, শিশুর সঙ্গে মর্মান্তিক ঘটনার তালিকা লম্বা হলেও বিচার নিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা কম। অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। কোথাও আছে তদন্তে গড়িমসি, কোথাও বিচারের জন্য অপেক্ষা বছরের পর বছর। তবে সিলেটের রাজন ও খুলনার রাকিব হত্যা মামলার দ্রুত বিচার শেষ হয়েছে। তা অন্যান্য ঘটনায় বিচারপ্রার্থীদের আশান্বিত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, একসময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল। পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যেতেন। এখন স্বামী-স্ত্রী তাদের মধ্যকার দাম্পত্য সমস্যা নিয়ে অনেক  ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না, যার পরিণতি হয় ভয়ানক। অনেকে সন্তানকে হত্যা করে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। তিনি বলেন, সহজাতভাবে মানুষের রাগ-ক্রোধ নিম্নমুখী হয়। এসবের প্রকাশের জন্য তারা সহজ টার্গেট নির্বাচন করে। তাই দেখা যায় ছোটদের সঙ্গে নৃশংস আচরণ করে বড়রা রাগ-ক্রোধ প্রকাশ করে। এ ছাড়া আমাদের সমাজে এখন সব কিছুতে এক ধরনের প্রতিযোগিতার চাপ রয়েছে। যে চাপ অনেকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে। পারিবারিক ও সামাজিক নানা অসঙ্গতিও অনেকের মনের মধ্যে অশুভ ছায়া ফেলে। যার শিকার হয় শিশুরা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ  তৈরি করা। তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় জীবনধারণের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন হয়েছে। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক আগের মতো দেখা যায় না। প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীকে চেনেন না। আবার সন্তানের সিজোফ্রেনিয়াসহ অন্য কোনো সমস্যা হলে মা-বাবা লুকানোর চেষ্টা করে। কোনো মানসিক সমস্যা হলে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবে- এ ভেবে কাউন্সেলিং করানো হয় না, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কোনো সমস্যা দেখা দিলে ব্লেম গেইম না করে সমস্যা সমাধানে পরিবারের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর