শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

গয়না গ্রাম ভাকুর্তা

মোস্তফা কাজল, সাভার থেকে ফিরে

গয়না গ্রাম ভাকুর্তা

গয়নার গ্রাম হিসেবে সাভার উপজেলার ভাকুর্তা ইউনিয়নের ভাকুর্তা গ্রাম সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে। এ গ্রামের প্রতিটি ঘরের উঠোন, দরজা, ঘরের ভিতরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অলঙ্কার তৈরির সরঞ্জাম। বেশিরভাগ বাড়ির বারান্দায় উজ্জ্বল আলোয় উঁকি দিচ্ছে আগুনের ফুলকি। পুরো গ্রামেই চলছে এ কর্মযজ্ঞ। যুবক, ছেলে-বুড়ো, মা-মেয়ে-বউ সবাই ব্যস্ত গলার হার, হাতের চুড়ি, কানের দুল, ঝুমকা, চেইন, পায়েল, নূপুর তৈরিতে। এ গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার এ ব্যবসা করে লাখপতি বনে গেছে। এ গ্রামের সড়কের পাশে, বাজারে বাজারে গড়ে উঠেছে গয়নার কারখানা ও দোকান। রাজধানী ঢাকার অতি সন্নিকটে অবস্থিত হলেও অবহেলিত জনপদ ছিল এই ভাকুর্তা। বেকার জীবন যাপন ছিল বেশিরভাগ মানুষের। এই জনপদে আজ আর কেউ বেকার নেই। ছোট-বড় নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত তামা ও পিতল দিয়ে গয়না তৈরিতে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঠুক ঠাক শব্দে নানা ধরনের গয়না তৈরিই তাদের পেশা। সংসারে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা। এই জনপদকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গয়নাশিল্প। এ কাজে এত মানুষ যুক্ত হওয়ার কারণ রোদ-বৃষ্টি-বাদলের মধ্যেও কাজ চলে সমান তালে। বাড়ির বউ-ঝিয়েরাও গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে করতে পারেন এ কাজ। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে যুক্ত হয় শিক্ষার্থীরা। অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ ঘটিয়ে তা নান্দনিক গয়নায় রূপ দেন তারা। গয়নার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনা-রুপার তৈরি নারীদের পরিধানযোগ্য বিভিন্ন গয়না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রাত্যহিক জীবনেও মেয়েদের প্রয়োজন হয় গয়নার। নিরাপত্তা কিংবা দামের কারণে সোনার পরিবর্তে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইমিটেশন বা সিটি গোল্ডের গয়না। বাজারে রয়েছে এর বিপুল চাহিদা। ঢাকার নিউমার্কেট, আজিজ সুপার, চাঁদনী চকসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় সব বড় শপিং মলের গয়না আসে ভাকুর্তা থেকে। মার্কেটগুলোতে সিটি গোল্ড বা অ্যান্টিক নামে এসব গয়না বিক্রি হয়। শুধু দেশে নয়, এখানকার গয়নার চাহিদা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে রপ্তানি হচ্ছে দুবাই, কাতার, বাহরাইন ও কুয়েতে। এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দেশের অর্থনীতিতে। ভাকুর্তা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী মোগরাকান্দা, মুসরিখোলা, ডোমরাকান্দা, বাহের চর, ঝাউচর, লুটের চর, চুনার চর, চাপড়া ও চাইরা গ্রামে  তৈরি হয় গয়না। বছরে গড়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকার গয়না তৈরি হয় এ গ্রামে। গ্রামগুলোতে বসবাস করা মানুষদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস গয়না তৈরি। স্বর্ণ ও রুপার উচ্চ মূল্যের কারণে সাভারের ভাকুর্তা বাজার ও আশপাশের গ্রামগুলোতে গয়না তৈরি করা হয় তামা ও পিতল দিয়ে। এখান থেকে সেগুলো পাইকাররা কিনে নিয়ে পরিশোধন ও রং করে বাজারে বিক্রি করে থাকেন, যা সিটি গোল্ড বা ইমিটেশন নামে পরিচিত। সরেজমিন ভাকুর্তায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বাজারের বটগাছ ঘেঁষে সারি সারি গয়নার দোকান। কিছু পাকা, কিছু আধাপাকা, কিছু টিনের ঘর। কারিগররা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তৈরি করছেন গলা, নাক, কান, পা, কোমর, মাথার বিভিন্ন ডিজাইনের গয়না। সামনে, পেছনে, দেয়ালে থরে থরে সাজানো মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের গয়না। গয়না তৈরিতে যত কাঁচামালের প্রয়োজন সবই সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। বাজারের সব দোকানঘরই সাজানো-গোছানো। সেখানকার আমেনা জুয়েলারি ওয়ার্কশপের মালিক মো. সাদেক মিয়া জানান, তাদের তৈরি গয়নাগুলো পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় ২০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকায়। ডিজাইন ও আকারের ওপর নির্ভর করে দাম। যেমন নেকলেস ১০০ থেকে ১ হাজার টাকায়, চুড়ি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা জোড়া, সীতাহার ৬০০ থেকে ১১০০ টাকা, নূপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার ঝাপটা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, হাতের মালতাশা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, খোঁপার কাঁটা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, টায়রা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়, শাড়ির মালা ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা, নাকের ফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা, টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যখন মার্কেটে খুচরা বিক্রি করেন, তখন এর দাম দেড় থেকে দুইগুণ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ভাকুর্তা বাজারের কারিগর বেচারাম দেওরি জানান, গহনা তৈরির কাঁচামাল তামা কিনে নিয়ে আসা হয় ঢাকার কোতোয়ালি থানার তাঁতীবাজার থেকে। দাম পড়ে কেজি ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে আয় হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। ভাকুর্তা বাজারের স্বর্ণ, রৌপ্য ও ইমিটেশন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানান, এ বাজারের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। এখানে দোকান রয়েছে ১৩০টির মতো। ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ এই পেশার ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর