মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

লড়াই জাপানি বিনিয়োগ ধরার

কার্যকর উদ্যোগ ও বিনিয়োগে বাধা দূর করতে দুই প্রধানমন্ত্রীর টেলিসংলাপ

মানিক মুনতাসির

লড়াই জাপানি বিনিয়োগ ধরার

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আপাতত জাপানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। দেশটির বিনিয়োগ ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি বিশেষ ক্ষেত্রে জাপানি কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীদের কারখানা স্থাপনে বিশেষ ছাড় দেওয়ার কথাও ভাবছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন থেকে ৮৭টি জাপানি কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে। সেই বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনতে নানাভাবে কাজ করছে সরকার। এ জন্য সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে টেলিসংলাপও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া গত মাসের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ-জাপানের সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপ (জুম প্ল্যাটফরমে ভার্চুয়ালি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সহজ করা, করনীতির জটিলতা কমানো ও শুল্কবাধা দূর করার তাগিদ দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক এবং  ৫ আগস্ট দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর টেলিসংলাপের পর একটি সারমর্ম তৈরি করা হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জাপান দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব বাধা দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলোআপ (অগ্রগতি) সভা অক্টোবরের পরপরই অনুষ্ঠিত হবে। সূত্র জানায়, জাপানি বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ পেতে হলে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে। এর মধ্যে ট্যাক্সেস বা করনীতি, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও ব্যবসার মুনাফার অংশ নিজ দেশে প্রত্যাবাসন পদ্ধতিগুলো আরও সহজ করতে হবে। পাশাপাশি যেসব জাপানি বিনিয়োগকারী এ মুহূর্তে এ দেশে বিনিয়োগরত আছেন, তারাও নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। সেগুলো দূর করতে হবে। অবশ্য এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে করনীতি সহজ করা, বন্দরসুবিধা আরও উন্নত করা, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও কাস্টমস জটিলতা নিসরনে নেওয়া উদ্যোগগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য অক্টোবরে আবারও একটি ভার্চুয়াল সভার আয়োজন করা হবে বলে জানানো হয়েছে জাপান দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্টদের। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ও জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে বলেও জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামো দুর্বলতা, নীতির অস্পষ্টতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। চীন থেকে ৮৭টি জাপানি কোম্পানি বিনিয়োগ তুলে নিয়ে থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, মালয়েশিয়ার মতো দেশে গেলেও বাংলাদেশে আসেনি একটি কোম্পানিও। এমনকি সারা বিশ্ব যখন আইসিটি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করছে, সেখানে আইসিটি খাতেও চাহিদা অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিকে আনতে পারছে না বাংলাদেশ। অন্যদিকে সারা দেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার যে কাজ চলছে, সেখানেও গত এক দশকে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যৎসামান্য। তবে জাপান, ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) আশা করছে, এসব অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বিনিয়োগ আসবে। যদিও চীনত্যাগী ৮৭টি জাপানি কোম্পানির একটিও বাংলাদেশে স্থাপিত জাপানিদের জন্য নির্ধারিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে আসেনি। তবে বেজা ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশও জাপানি বিনিয়োগ পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। এ জন্যই জাপানিদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার জন্য ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অঞ্চলটি উন্নয়নও করছে জাপানের সুমিতমো করপোরেশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমিজমা-সংক্রান্ত আর কোনো সমস্যা থাকবে না। পাশাপাশি করনীতি, কাস্টমস বা অন্য যেসব জটিলতা রয়েছে, সেগুলো নিরসনেও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগের এটাই মুখ্য সময়। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমানে আমাদের দেশে বিনিয়োগের এক চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করছে।’ সূত্র জানায়, ভার্চুয়াল ওই সভার কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, প্রারম্ভিক বক্তৃতায় এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ বলেন, করোনার মধ্যেও এ ধরনের সভা দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। ধারাবাহিক সভার মাধ্যমে দুই দেশের বিনিয়োগ সমস্যা নিরসনে একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি সম্ভব হবে। বিশেষ করে পিপিইডি দুই দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সেতুবন্ধ তৈরিতে সহায়ক হবে। এ সময় তিনি বলেন, ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপ হয়। দুই প্রধানমন্ত্রী করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক করা ও দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। সভায় জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করব, যেন জাপানি বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়ন করে। এর মধ্যে ট্যাক্সেস বা কর সমস্যা নিরসন, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও ব্যবসার লাভের টাকা নিজ দেশে প্রত্যাবাসন পদ্ধতি সহজ করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’ তিনি বলেন, এখন যেসব জাপানি বিনিয়োগকারী এ দেশে বিনিয়োগ করেছেন, তারাও এসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। জানা গেছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ দ্বিগুণ হয়েছে। কভিড-১৯ দুই দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। সারা বিশে^ই এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। তবে কভিড-পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বে নতুন করে সব ধরনের চাহিদার সৃষ্টি হবে। এতে সামনের দিনগুলোতে ব্যবসা-বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে জাপানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৮৭টি কোম্পানির ৫৭টি জাপানে ফিরে যাচ্ছে। আর ৩০টি কোম্পানি চীন ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) ওয়েবসাইটে চীন ছেড়ে জাপানের বাইরে অন্য কোনো দেশে যাওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেই তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০টির মধ্যে ১৫টি কোম্পানি ভিয়েতনাম, ছয়টি থাইল্যান্ড, চারটি মালয়েশিয়া, তিনটি ফিলিপাইন, দুটি লাওস, একটি ইন্দোনেশিয়া এবং একটি মিয়ানমারে যাচ্ছে। দুটি কোম্পানি কারখানা দুই দেশে নিচ্ছে।

জাপান কারখানা সরাতে যে সহায়তা দিচ্ছে, তা মূলত আসিয়ানভুক্ত (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন) দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য। আঞ্চলিক এই জোটের সদস্য ১০টি দেশ ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও লাওস। বিনিয়োগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে আসিয়ান দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে জাপান সরকার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নীতি জটিলতা, অবকাঠামো সংকট আর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব প্রকট। এ জন্যই আমরা বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছি। এর চেয়েও বড় কথা, এখানে বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসা করতে এলে কী ধরনের জটিলতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কেও পরিষ্কার জানেন না বিদেশিরা। কী ধরনের জটিলতায় পড়তে হবে এটা জানতে পারলে তাদের একটা প্রস্তুতি থাকত। কিন্তু আমরা তো সেটি পরিষ্কার করতে পারি না। আছে নীতির অনিশ্চয়তা। ফলে এটা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটা মারাত্মক হুমকি। এ জায়গাগুলো আরও দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’

সর্বশেষ খবর