কক্সবাজারের উঁচু পাহাড়ে বস্তির মতো খুপরি ঘরে ক্যাম্পগুলোতে নানান ধরনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকছে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর সঙ্গে ভাসানচরের রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাত। ভাসানচরে এলে রোহিঙ্গাদের নিজেদের যেমন ঝুঁকি কমে যাবে, তেমনি বাংলাদেশেরও পরিবেশ ভারসাম্য ও মাদক-মানব পাচারের ঝুঁকি কমে যাবে শতভাগ। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনের পূর্ব অভিজ্ঞতার পর ভাসানচর ঘুরে স্পষ্ট এ পার্থক্য যে কারও চোখে পড়বে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়গুলোতে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা হলো বর্ষাকালে ভূমিধসের। এজন্য বছরের যে কোনো সময় একনাগাড়ে দুই দিন বৃষ্টি হলেই তটস্থ থাকতে হয় স্থানীয় প্রশাসনকে। আশঙ্কা থাকে, যে কোনো সময় পাহাড়ধসে মৃত্যু হতে পারে শত শত রোহিঙ্গার। ঘরগুলো অস্থায়ী হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ভাসানচরে এ ধরনের ভূমিধসের আশঙ্কা নেই বিন্দুমাত্র। তেমনি ১২০টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার থাকায় ঘূর্ণিঝড়সহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা অনেকাংশেই নিরাপদ। একইভাবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে যেখানে বনের পর বন উজাড় হচ্ছে সেখানে ভাসানচরে রয়েছে বিশাল বনায়নের সুযোগ। কক্সবাজারে যেখানে জীব- বৈচিত্র্যের অবক্ষয়, উচ্চ বায়ুদূষণ, ভূগর্ভস্থ জলের দূষণ, পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে ভাসানচরে হবে না মাটি ক্ষয়, হবে না বায়ুদূষণ এবং থাকবে না ভূমিধসের ঝুঁকি। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর বাঁশ এবং টারপলিন দিয়ে তৈরি ঘরগুলো যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য উচ্চমাত্রায় সংবেদনশীল, সেখানে ভাসানচরে জাতিসংঘের নির্দেশনা মেনে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ৩.৯ বর্গমিটার স্থান বরাদ্দ করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ক্লাস্টার হাউস।
এমনিতেই টেকনাফ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থা সীমিত। সেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিশাল জনগোষ্ঠীর দৈনিক পানি ব্যবহারের কারণে পানির স্তর দিন দিন কমে যাচ্ছে। সেখানে ভাসানচরে জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মান অনুসারে ভূগর্ভস্থ পানি এবং পুকুর, হ্রদ, খালের পানির সুবিধা রাখা আছে। সেই সঙ্গে আছে বৃষ্টির পানির আধুনিক সংরক্ষণ ও ব্যবহার পদ্ধতি। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে প্রায়ই খাদ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় দেখা দেয় জটিলতা। দীর্ঘ পথে খাদ্য পরিবহন করতে হয়, রয়েছে খাদ্য গুদামের অভাব ও জায়গার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু ভাসানচরে খাদ্য ও ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য সুবিশাল চারটি গুদাম ঘর। এর প্রতিটি গুদাম ২০৫ ফিট লম্বা এবং ৭১ ফিট চওড়া।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। রাস্তাঘাটগুলোতে নেই লাইটের ব্যবস্থা, ফলে সন্ধ্যা হলেই অধিকাংশ অঞ্চল হয়ে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের আলো নিভলেই শুরু হয় অরাজকতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখা। বিপরীতে ভাসানচরের পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো। এখানে রয়েছে ডিজেল জেনারেটর, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা, সৌরশক্তির মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, রুফটপ সোলার ব্যবস্থা। ফলে প্রতিটি ঘরে, রাস্তাঘাটে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা থাকবে সার্বক্ষণিক। পানির ব্যবস্থা থাকবে সব সময়। টেকনাফ-উখিয়ার বসবাস অনুপযোগী ক্যাম্পগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত ঘনবসতির কারণে স্থান ব্যবস্থাপনা জটিল। অনেক সময়ই ব্যবস্থাপনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু ভাসানচরে এই ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার একেবারে নিয়ন্ত্রিত ও সহজসাধ্য। অল্প জায়গায় বাঁশ ও টারপলিনের ঘরগুলোর কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঝুঁকি যেমন বেশি, তেমনি আগুন নেভানোর ব্যবস্থাও অপ্রতুল। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আগুনের ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়। কিন্তু ভাসানচরের পরিকল্পিত ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থা আগুনের ঝুঁকি কমিয়েছে অনেকাংশেই।
উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্পগুলোতে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই সীমিত। সেখানে রাস্তাঘাট নির্মাণও যথেষ্ট ব্যয়বহুল। ফলে সীমিত সড়কের ওপর চাপ পড়ে বেশি, হয় যানজট। কিন্তু ভাসানচরে পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তা নির্মাণ করায় এবং সব আশ্রয় কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থা থাকায় যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে অনেক বেশি। কক্সবাজারে টেলিযোগাযোগ সুবিধা কম ও অধিক জনসংখ্যার কারণে ব্যবস্থাপনায় অসুবিধা সৃষ্টি হয় প্রায়ই। কিন্তু ভাসানচরে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু ভাসানচরের জন্যই গ্রামীণফোন ও রবি টাওয়ার নির্মিত হয়েছে। টেলিটকের টাওয়ার স্থাপনের কাজ চলছে পুরোদমে। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে নেই জীবিকা-নির্বাহের তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু ভাসানচরে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প, মহিষসহ অন্যান্য পশুপালন ও পানির প্রক্রিয়াজাতকরণ, মৎস্য চাষ, পর্যটনশিল্প স্থাপন, অর্থনৈতিক জোন স্থাপন ও ভোকেশনাল ট্রেইনিং সেন্টার নির্মাণ ইত্যাদির সুযোগ রয়েছে।
এখনকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর কারণে কক্সবাজারের পর্যটনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবাসন হলে পর্যটনের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের বিরোধ দিন দিন বাড়ছে। ফলে প্রায়ই মুখোমুখি অবস্থানে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের। কিন্তু ভাসানচরে এ ধরনের কোনো ঝুঁকি এখন নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই। এখনকার ক্যাম্পগুলোর বিশৃঙ্খলাপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিপরীতে ভাসানচরে রয়েছে পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার কোনো জায়গাই নেই। সেখানে ভাসানচরে রাখা হয়েছে আলাদা দুটি খেলার মাঠ। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে রয়েছে স্বল্প পরিসরে খেলার ব্যবস্থা। এ ছাড়া ভাসানচরে কোনো রোহিঙ্গার মৃত্যু হলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অনুসারে সৎকার করে কবর দেওয়ার জন্য কবরস্থানও নির্ধারিত রয়েছে।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে প্রাথমিক সফলতা : ইতিমধ্যে দুই দফায় মোট ৩০৬ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দিয়ে সফলতা এসেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে এরা সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আটক হয়েছিল। এই ৩০৬ জনের মধ্যে পুরুষ ৯৭ জন, মহিলা ১৭৬ জন এবং শিশু ৩৩ জন। তাদের নৌবাহিনীর মাধ্যমে তিনবেলা নিয়মিত পুষ্টির দিক বিবেচনা করে রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। নামাজের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। একজন পুরুষ ও একজন নারী ডাক্তার তাদের চিকিৎসা করছেন। নৌবাহিনী তাদের বাচ্চাদের জন্য অস্থায়ী স্কুলের ব্যবস্থা করেছে। শিক্ষা উপকরণ দিয়ে রোহিঙ্গাদেরই দুজনকে শিক্ষক নির্বাচন করে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আরবি, ইংরেজি ও মিয়ানমার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। মহিলাদের জন্য সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। করা হচ্ছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। পুরুষদের চুল কাটার প্রশিক্ষণ দেওয়া ও কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে এই রোহিঙ্গাদের।