শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

অসম প্রেমের নিষ্ঠুর পরিণতি

মির্জা মেহেদী তমাল

অসম প্রেমের নিষ্ঠুর পরিণতি

বাইশ বছরের জকিরুল ইসলাম। রংপুরের বদরগঞ্জ থানার শেমপুর রেলস্টেশনের একটি দর্জির দোকানের সহযোগী। সাইকেলে চড়ে গোপালপুর পশ্চিমপাড়া হতে নিয়মিত দোকানে আসত। একসময় বিয়েও করেছিল। কিন্তু টেকেনি।

একরাতে সে বাড়ি ফিরে না। অনেক খোঁজ করেও তার সন্ধান মেলে না। এক দিন পর লোকমুখে শোনা যায়, তার বাইসাইকেলটি প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের হরিপুর গ্রামের একটি বাঁশঝাড়ে পড়ে আছে। লোকমুখে শুনে জকিরুলের পরিবারের সদস্যরা ছুটে যায়। কিন্তু বাইসাইকেলটি তারা খুঁজে পায় না। বাই সাইকেলটিকে দেখেছে, সেটাও কেউ জানে না। বদরগঞ্জ থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি হয়। জকিরুল আর ফেরে না। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর জকিরুলের বাবা কৃষক আজাদ আলী হরিপুর গ্রামের বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি বাড়ি এমন কিছু মানুষের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা করেন। কিন্তু জকিরুলের কোনো খবর নেই। এক মাস পর মামলার তদন্তের ভার পড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর ওপর। হরিপুর গ্রামের একটি প্রভাবশালী যৌথ পরিবারের কিশোরী শান্তা (ছদ্মনাম) শেমপুর ভিআইপি শাহাদাত হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। জকিরুলের নিরুদ্দেশের পর থেকে সেও নিখোঁজ। জকিরুলের বাবার মামলার পর সন্দেহভাজন অভিযুক্তরাও একে একে গাঢাকা দিতে থাকে। এরা সবাই শান্তার পরিবারেরই সদস্য।

পিবিআই জকিরুল অপহরণের মামলার রহস্য উদঘাটনে আশার আলো দেখতে পায়। তারা শান্তার অবস্থান জানার চেষ্টা করে। তাদের

কাছে খবর আসে সেই শান্তা রয়েছে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায়। পিবিআই সেখানে হানা দেয়। কিন্তু সেখানে নেই সেই শান্তা। পিবিআই যাওয়ার আগেই সেখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে।

পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তারা হতাশ। কীভাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সময় গড়াতে থাকে। মামলার তদন্তের গতিও কমে। জকিরুলের পরিবার তাদের সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে। লাশ পর্যন্ত আর তারা খুঁজে পাবে না বলেও নিশ্চিত। কারণ আসামিরা ধরাও পড়ছে না। পুলিশের তদন্তেও নেই কোনো অগ্রগতি। এমনি এক অচলাবস্থার মধ্যেই মামলার মোড় হঠাৎ ঘুরে যায়। এক বিকালে পিবিআই দফতরে এক কিশোরী সশরীরে হাজির হয়ে বলে, আমার কিছু বলার আছে। কিশোরিটি তখন হাঁপাচ্ছিল। কর্মকর্তারা তার পরিচয় জানতে চায়। সে তখন বলে, আমার নাম শান্তা। আমি জকিরুলের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। এ কথা শুনেই নড়েচড়ে বসে কর্মকর্তারা। বলে, তুমি এখন নিরাপদ। তুমি বলতে পার। শান্তার পরিবার ভেবে ছিল পুলিশ সব ভুলে গেছে। আর কিছুই হবে না। জামিন নিলেই মামলা শেষ। তাই তারা শান্তাকে সঙ্গে নিয়েই গোপনে রংপুর ফিরে আসে। শান্তা তাদের কাছ থেকে পালিয়ে পিবিআই-তে এসে উপস্থিত। শান্তা সব ঘটনা খুলে বলে পিবিআইর কাছে। যা আদালতেও বলে দেয়। শান্তা আদালতে বলে-জকিরুলকে সে ভালোবাসত। কাপড় তৈরির জন্য দর্জি দোকানে তার যাতায়াত। সেই সুবাদে জকিরুলের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম। প্রেমের বয়স প্রায় দেড় বছর। এ ভালোবাসা সজীব রাখার জন্য সে একটি মোবাইল ফোন গোপনে ব্যবহার করত যা জকিরুল তাকে দিয়েছিল। তার পরিবারের সদস্যরা কেউ জানত না এ মোবাইল ফোনের খবর। অপহরণের রাতে জকিরুল তার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে আসে। পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখে ফেলে। ছেলেটিকে তারা নিয়ে যায়। প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর তার চাচা তাহেরুল ইসলাম ফিরে আসে। সঙ্গে জকিরুলের কাপড়-চোপড় ও স্যান্ডেল। চাচি মনোয়ারা বেগম ওগুলো পুঁড়িয়ে ফেলে। শান্তা কিছু একটা বুঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। ভোররাতে জ্ঞান ফিরলে সে সহ-মরণের উদ্দেশ্যে কীটনাশক পান করে। রংপুরের ডাক্তাররা তাকে বাঁচিয়ে তোলে। পিবিআই শান্তার দাদা সিরাজুল হক, বাবা জাহাঙ্গীর ও চাচা তাহেরুলকে গ্রেফতার করে। তাদের নিয়ে একবুক মাটির নিচ হতে কাপড়ে মোড়া একটি কঙ্কাল সদৃশ্য মরদেহ উদ্ধার করে, যা শান্তাদের বাড়ি হতে প্রায় ৮০০ গজ দূরের একটি বাড়ন্ত ফসল খেতের নিচে ছিল। ডিএনএ পরীক্ষায় নির্ধারিত হয় কঙ্কালটি জকিরুলের। জকিরুলের অপরাধ তিনি সামাজিকভাবে অসম একটি পরিবারের এক কিশোরীর সঙ্গে বাঁধভাঙা ভালোবাসায় জড়িয়ে ছিলেন। একটি গ্রামের শক্তিশালী যৌথ পরিবারের প্রায় সব সদস্য একটি কিশোর প্রেমের বাস্তবতাকে সামাল দিতে না পেরে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়েছে। পরিবারের সদস্যদের একটু সচেতনতাই পারত পরিবারটির তছনছ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে। সূত্র : রংপুর জেলার বদরগঞ্জ থানার মামলা নং-১৩, তাং-১৩/৪/২০১৭ইং।

সর্বশেষ খবর