রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

কথা হয়, কাজ হয় না

কেমিক্যাল গোডাউন সরছে না, হুমকির মুখে পুরান ঢাকা, প্রাণ গেল ২ শতাধিক

গোলাম রাব্বানী

ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউনের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে পুরান ঢাকা। চুড়িহাট্টা থেকে নিমতলী, সবশেষ গত শুক্রবারের আরমানিটোলার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রাণ গেছে প্রায় দুই শতাধিক মানুষের। অগ্নিকান্ডের পরপরেই পুরান ঢাকাকে কেমিক্যালমুক্ত করার আশ্বাস দেয় হাইকমান্ড। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। সুপারিশ আসে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর। এমনকি কেমিক্যাল গোডাউন কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের ২৩২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। গোডাউন সরানো নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতির হয়নি। কোনো উদ্যোগ আজও আলোর মুখ দেখেনি। বিশ্লেষকদের মতে, শুধু কথায় হয়, কাজ হয় না। এমন কি মন্ত্রণালয় ও বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে আদালতের দ্বারস্থ হয়েও কোনো লাভ হয়নি। এ ছাড়া ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর হাই কোর্টের নির্দেশে গঠিত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির দেওয়া ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি আজও। আইনজ্ঞরা বলছেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে অগ্নিকান্ড অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। কমে যেত অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সময় এসেছে যারা দায়িত্ব পালন করেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। যে কোনো কর্মকর্তা হোন না কেন তার সঠিক দায়িত্ব পালন না করলে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। লাইসেন্স প্রদানে অনিয়ম ও তদারকির  অভাবেই আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে কেমিক্যাল গুদাম, ঘটছে দুর্ঘটনা। আরমানিটোলার অগ্নিকান্ডের পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ না এটাকে একটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব হিসেবে সময়লব্ধ অনুযায়ী কাজ না করবে, ততক্ষণ এটা আসলে সমস্যা রয়েই যাবে। তালিকা সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে রকম কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আমরা পাচ্ছি না। এ ছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকার জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেছেন, হাজী মুসা ম্যানসনের নিচতলা ও দোতলার কেমিক্যালের গোডাউন ‘সিলগালা’ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এই ভবনের নিচতলা ও দোতলার বেশিরভাগ কক্ষে কেমিক্যালের গোডাউন। আমরা মালিকদের বলেছি দ্রুত কেমিক্যাল সরিয়ে নিতে। না সরানো পর্যন্ত দোতলা ও নিচতলা সিলগালা করা থাকবে।’

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১২৪ জন মানুষ। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে আরেক মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা। এ ঘটনায় প্রাণ হারান ৭৮ জন। শুক্রবার ভোরে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসন নামের একটি ছয়তলা ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুন লাগে। এই ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০ জন দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এদিকে পুরান ঢাকায় ২৫ হাজারেরও বেশি ২০০ ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদিত রয়েছে মাত্র আড়াই হাজার। আর এসব কেমিক্যাল গোডাউনের কারণে আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে পুরান ঢাকার মানুষদের। আতঙ্কের কারণ ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের গোডাউন। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গণমাধ্যমকে বলেছেন, সিটি করপোরেশন থেকে বাণিজ্য অনুমতি ছাড়াই তারা কীভাবে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে, কীভাবে গুদামজাত করে এবং কীভাবে তারা ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছে, সবার চোখের সামনে দিয়ে এগুলো আসলে খুবই অবাক কান্ড। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ না এটাকে একটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব হিসেবে সময়লব্ধ অনুযায়ী কাজ না করবে ততক্ষণ এটা আসলে সমস্যা রয়েই যাবে। মেয়র আরও বলেন, তালিকা সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে রকম কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আমরা পাচ্ছি না। চলতি বছরের শুরুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পুরান ঢাকার সব অবৈধ কেমিক্যাল কারখানা এবং প্লাস্টিক গোডাউন সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিকল্প জায়গা দেওয়ার পরও মূলত মালিকদের একগুঁয়েমির কারণে সরানো যাচ্ছে না এসব কারখানা ও গোডাউন। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্যবস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলে এখানে। অবৈধ ব্যবসায়ীদের তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

২০১০ সালের জুন মাসে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখনো সরেনি একটি কারখানাও। ২০১৯ সালে আবার আগুন লাগে চুড়িহাট্টা এলাকায়। ঝরে পড়ে ৭৮টি তাজা প্রাণ। কারখানা সরাতে আবারও গঠিত হয় কমিটি। এর পরেও সরেনি গুদাম।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর