শিরোনাম
বুধবার, ১৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনি পাঁচ ছেলে

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনি পাঁচ ছেলে

টঙ্গীর ব্যবসায়ী ফকরুল ইসলাম। গাজীপুরের বাসন এলাকার মোহাম্মদ আলীর কাছে তিনি সোয়া লাখ টাকা পান। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও টাকা ফেরত পাচ্ছিলেন না। এ জন্য মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে যান তিনি। কিন্তু তার ছেলেরা তাকে জানায়, তাদের বাবা বাড়িতে নেই। ফকরুল ফেরত যান। কদিন পর তিনি আবারও মোহাম্মদ আলীর বাসায় তাগাদার জন্য যান। ছেলেরা এবার জানায়, তাদের বাবা, সৎ মা চায়না বেগম এবং সৎ ভাই কোথায় চলে গেছেন তারা জানেন না। এ কথা শুনে ঘাবড়ে যান ফকরুল। আশপাশ এলাকার লোকজনের কাছে মোহাম্মদ আলীর খবর জানতে চান তিনি। স্থানীয়রা জানায়, তারাও শুনেছেন মোহাম্মদ আলী তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিখোঁজ। তবে ছেলেরা এ ব্যাপারে থানা পুলিশ করেনি। খোঁজখবরও নেয়নি। উটকো বিপদের আশঙ্কায় ফকরুল সেখান থেকে চলে যান। ঘটনাটি ২০০৫ সালের। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বাসন এলাকার বাসিন্দা এই মোহাম্মদ আলী (৬০)। পেশায় তিনি একজন কৃষক। স্ত্রী ও পাঁচ ছেলে সন্তানকে রেখে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন কুড়িগ্রামের চায়না খাতুনকে। তাদের ঘরে এক সন্তান রয়েছে। নাম ইমরান। বয়স চার বছর। সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ করেই এই তিনজন নিখোঁজ। এদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু মোহাম্মদ আলীর পাঁচ ছেলে আত্মীয়স্বজন ও এলাকার লোকজনের কাছে একেক সময় একেক ধরনের কথা বলে। শেষাব্দি তারা জানায়, তাদের বাবা রাগ করে তাদের সৎ মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে বাসা থেকে চলে গেছেন। সৎ মায়ের বাড়ি রংপুরে রয়েছে। দিন যায়, মাস যায়, বছরের পর বছর গড়ায়। এই তিনজন আর ফেরে না গাজীপুরে। এলাকার লোকজনও এই মোহাম্মদ আলীর কথা একরকম ভুলেই গেছেন। পাঁচ ভাই পরিবার-পরিজন নিয়ে আলাদা আলাদা বসবাস করছেন। সবাই ভুলে গেলেও সেই ব্যবসায়ী ভোলেননি। তিনি পান সোয়া লাখ টাকা। উল্টো তিনি নিজেই অজানা আতঙ্কে টাকা চাইতে পারছেন না ছেলেদের কাছে। তার যখনই মনে পড়ে, তখনই তিনি খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। তিনি খোঁজখবর নিতে মোহাম্মদ আলীর গ্রামের বাড়ি যান। সেখানে গিয়ে ঠিকানা নেন দ্বিতীয় স্ত্রী চায়না বেগমের। তিনি চলে যান কুড়িগ্রাম মোহাম্মদ আলীর শ্বশুরবাড়িতে। বাড়িতে ছিলেন শাশুড়ি জরিনা বেগম। তিনি ফকরুলকে বলেন, ‘তার মেয়ে চায়না বেগম, মেয়েজামাই আর নাতিরে খুন করে ফেলেছে। এলাকার লোকজন বলেছে।’ পুলিশের কাছে যাননি কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জয়দেবপুর থানায় গিয়ে দেখি প্রথম পক্ষের ছেলেরা ঘোরাঘুরি করছে। তারা আমাকে থানার বাইরে নিয়ে যায়। আমাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। ভয়ে আমি আর ঢাকায় যাইনি।’ ব্যবসায়ী নির্ভয় দিলে জরিনা বেগম চলে আসেন ঢাকায়। ঘটনার ১১ বছর পর ২০১৬ সালের মে মাসে র‌্যাবের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনার বর্ণনা করেন তিনি। র‌্যাব এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনার তদন্ত করতে মাঠে নামে। গ্রেফতার করে মোহাম্মদ আলীর চার ছেলেকে। আরেক ছেলে পালিয়ে যায় অভিযান টের পেয়ে।

এরপরের গল্প মানুষরূপী চার অমানুষের। যারা নিজ জš§দাতা বাবা আর সৎ মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছিল। আর চার বছরের সেই সৎ ভাই ইমরানকে ফেলে রেখে আসে সিলেটের শাহজালালের মাজারে। যার খোঁজ অদ্যাবদি কেউ দিতে পারেনি। বেঁচে থাকলে সেই চার বছরের শিশুটির বয়স এখন ১৫। এত বড় অপরাধ সংঘটনের পরও তাদের মধ্যে ছিল না কোনো বিকার। ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারেনি, বাবা-মাকে খুন করে সুন্দর জীবনযাপন করে যাচ্ছেন পাঁচ ভাই। তাদের কাছ থেকেই জানা যায়, তাদের বাবা-মা নিখোঁজ হয়নি। তারা সন্তানদের হাতে নির্মম খুনের শিকার হয়েছেন।

পুলিশের অভিযান : অভিযোগ পেয়ে র‌্যাব-১ বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে। নিখোঁজ ওই তিনজনের হদিস না পেয়ে তদন্তের একপর্যায়ে এএসপি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান রাজীবের নেতৃত্বে র‌্যাব-১-এর সদস্যরা গাজীপুর মহানগরীর বাসন এলাকার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ওই চার ভাইকে আটক করে। অভিযানকালে তাদের অপর ভাই আহসান হাবিব (৪৫) পালিয়ে যান। গ্রেফতার চার ভাই হলেন- মো. রমজান আলী, মো. বাবুল হোসেন, মো. আরফান আলী এবং মো. আকরাম আলী। এরা বাবা-মায়ের খুনের দায় স্বীকার করেন। তারা জানিয়েছেন, তাদের বাবা মোহাম্মদ আলী তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানকে ২০০৫ সালে ১০ শতাংশ করে মোট ২০ শতাংশ জমি লিখে দেন। এ নিয়ে তাদের মায়ের সঙ্গে বাবার ঝগড়া হতো। এই ঝগড়ায় মায়ের পক্ষ নিয়ে তারা বাবাকে গালমন্দ করতেন।

র‌্যাবের জেরায় মো. রমজান আলী জানান, ‘জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে এক রাতে আমরা পাঁচ ভাই বাবার রুমে ঢুকি। সৎ মা ও সৎ ভাইও সেখানে ছিল। সৎ মা ও ভাইকে জমি দেওয়ার বিষয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করি। বাবা বিষয়টি অস্বীকার করেন। এ সময় তারে গালাগাল করি। বাবা আমাদের জমি দেবে না বললে মাথায় রক্ত উঠে যায়। তাকে আমি থাপ্পড় দেই। বাবা পড়ে যান। বাবা উঠে আমাকে মারতে এলে আমি কিল ঘুষি দেই। আমার সঙ্গে আমার ভাইয়েরাও মারধর করেন বাবারে। বাবা খাটের ওপর পড়ে যান। পড়ে গেলে খাটের এক পাশে থাকা বালিশ নিয়ে আমরা দুই ভাই বাবার মুখে চেপে ধরি। বাকি দুজন বাবার পা চেপে ধরে রাখে। আরেকজন পাহারায় ছিল। শ্বাসরোধ করে বাবাকে হত্যা করি। তখন সৎ মা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। তখন তাকেও একই কায়দায় বালিশ চেপে ধরে হত্যা করি। বাবা ও সৎ মায়ের লাশ পাশের তুরাগ নদের সামনে নিয়ে যাই। প্লাস্টিকের বস্তায় মাটি ভরে লাশের কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে নদীতে ফেলে দেই। বাড়িতে এসে ওই রাতেই ছোট ভাই বাবুল ও আহসান সৎ ভাই ইমরান আলীকে নিয়ে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার সিলেটে যায়। সেখানে ইমরানকে ফেলে রেখে পালিয়ে গাজীপুরে চলে আসে। আমরা এলাকায় ছড়িয়ে দেই, বাবা রাগ করে চলে গেছেন।’

ঠিক এভাবেই রহস্যের জট খুলে ১৬ বছর আগে ঘটে যাওয়া নির্মম এই জোড়া খুনের ঘটনাটি। আসামিরা গ্রেফতার হন। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই ইমরানকে। র‌্যাব সিলেট শাহজালাল মাজারে গিয়ে খোঁজ করলেও কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর