রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ধানগাছের রং চেনাল লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

ধানগাছের রং চেনাল লাশ

ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় থাকতে চাচ্ছে না পুলিশ। অন্ধকার থাকতেই অনুসন্ধান চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে তারা। লাশের সন্ধানে ঢাকা থেকে একদল পুলিশ নেত্রকোনার একটি গ্রাম মোহনগঞ্জে এসে অবস্থান নিয়েছে। তাদের কাছে খবর ছিল, সন্দেহের তালিকার অন্যতম একজনকে পাওয়া যাবে মোহনগঞ্জে। কিন্তু টার্গেট করা বাড়িতে সেই সন্দেভাজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ আসার আগেই লাপাত্তা। তবে বাড়ির পেছনের একটি ধানখেতে সেই ব্যক্তিকে দেখা গেছে। গ্রামবাসীদের একজন পুলিশকে জানিয়েছে, এক রাতে টর্চ হাতে সেই ব্যক্তিটি ধানখেতে কিছু একটা করছিল। তারা এ বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এই তথ্যের সূত্র ধরে, পুলিশ ধানখেতে তল্লাশি শুরু করে। কিন্তু আধা ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালিয়েও কোনো ক্লুু খুঁজে পায় না পুলিশ। ইতিমধ্যে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। ৫-৬ জনের পুলিশের দল হতাশ। পুলিশের একজন কর্মকর্তা পাকা ধানখেতের দিকে আবারও চোখ বুলিয়ে নেয়। হঠাৎ তিনি দেখতে পান, খেতের একটি অংশে ধানগাছের রং সবুজ। ধানগাছগুলোও স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট। অন্ধকারে তল্লাশিতে ধানখেতের রঙের এই পার্থক্য চোখে পড়েনি। সন্দেহ হয় পুলিশ কর্মকর্তার। তিনি ছুটে যান  খেতের সেই অংশে। কাছে গিয়েই হতবাক। পাকা ধানখেতের একটি অংশে সবুজ রঙের ধানগাছ! দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সবুজ রঙের ধানগাছের চারাগুলো নতুন করে লাগানো হয়েছে। সন্দেহ হতেই আর দেরি করেনি। ধানক্ষেতে চালানো হলো কোদাল। মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এলো আস্ত একটি কালো রঙের ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্ক খুলতেই বেরিয়ে এলো পচা-গলা লাশ। যে লাশের খোঁজে পুলিশের দলটি ঢাকা থেকে নেত্রকোনায় আসে। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের গতি বেড়ে যায়। এবার খুনিদের ধরার পালা। ছুটতে শুরু করে খুনিদের অবস্থানের দিকে। রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই রুবেল নামে এক যুবক নিখোঁজ হন। ২ আগস্ট রুবেলের অর্ধগলিত লাশ এভাবেই নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের একটি ধানখেত থেকে পুলিশ উদ্ধার করে।  যাত্রাবাড়ীর এক আত্মীয়র বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রুবেল আর বাসায় ফেরেননি। মোবাইল ফোনও বন্ধ। তার আত্মীয়রা বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নেন। কোথাও নেই রুবেল। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জেও যাননি। তবে গেল কোথায়? দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন রুবেলের স্ত্রী পপি। ভাবছেন, দুই দিন পেরিয়ে গেল। একটিবারের জন্যও মোবাইল ফোন খোলেনি। তিনি যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করেন।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ কর্মকর্তা বেল্লাল ভাবছিলেন রুবেলের নিখোঁজ নিয়ে। কোথা থেকে শুরু করবেন তদন্ত, তা বুঝতে পারছেন না পুলিশের এই তরুণ কর্মকর্তা। দিনের বেলাতেই বিদেশফেরত একজন জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া হয়ে গেল! কোথাও নেই! তার কোনো শত্রু নেই, বন্ধুবান্ধব নেই। তবে কীভাবে তার খোঁজ করবে? রুবেলের স্ত্রী পপির সঙ্গে কথা বলেও তদন্ত কাজে আসবে, এমন কোনো তথ্যই পেলেন না।

বেল্লাল খুব ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। আগের দিন রিকুইজিশন দিয়ে রাখা মোবাইল ফোনের কল লিস্টটাও হাতে নিলেন। তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে জানতে পারলেন, রুবেলের সর্বশেষ অবস্থান। পূর্ব রামপুরা। এই এলাকাকেই টার্গেট করলেন তিনি। এই স্থানেই রুবেলের ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। বেল্লালের মনটা আজ ভালো। এলাকার নামটি জানতে পেরেছেন। এখান থেকেই অনেক দূর যাওয়া যাবে। কিন্তু পূর্ব রামপুরায় আছে শত শত বাসা। কোন বাসায় যাবেন তিনি? তা ছাড়া কার বাসায় ছিল রুবেল, তাও অজানা। নানা চিন্তায় হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি খেলল। ভাবল, রুবেলের বাড়ি নেত্রকোনা। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, নেত্রকোনার কোনো ভাড়াটিয়া কোনো বাসায় আছে। তিনি খোঁজ করতে লাগলেন। এক বাসা থেকে আরেক বাসা, এই বাসার পর ওই বাসা। এমন করতে করতে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আসে রাত। শরীর চলে না বেল্লালের। বাসায় ফিরে যান তিনি। ভাবছেন, পরদিন হবেই হবে। সেই মতে আবারও বাসায় বাসায় তল্লাশি। সেদিনও ব্যর্থ। চার দিন পেরিয়ে যায়। ৫ম দিন আবারও খোঁজ শুরু। প্রথম বাসা, দ্বিতীয় বাসা, তৃতীয় বাসাতেই কিছু একটা মিলেছে বলে মনে হলো তার। তিনি জানতে পারলেন, পূর্ব রামপুরার ৭৮/২৪ নম্বর বাসার ভাড়াটিয়ার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। রুবেলের বাড়িও মোহনগঞ্জ। কেমন যেন যোগসূত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বেল্লাল। দারোয়ানের কাছে শুনেই তিনি ভিতরে ঢুকলেন। দারোয়ান জানালেন, ওরা নেই। কবে আসবে বলে যায়নি। পুলিশের কর্মকর্তা দারোয়ানের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বাড়িওয়ালাকে ডেকে আনতে বলে। বাড়িওয়ালা চলে আসে। তিনি পুলিশকে জানান, বেশ কয়েক দিন আগেই তারা বাসা থেকে কিছু মালামাল নিয়ে গ্রামে গেছে। কবে আসবে কিছু বলেনি। কী নিয়ে গেছে? পুলিশের এই কর্মকর্তার প্রশ্নে বাড়িওয়ালা জানায়, আলমারি, শোকেস এবং একটি ট্রাঙ্ক ছিল তাদের সঙ্গে। পুলিশের এই কর্মকর্তার সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে। উত্তেজনায় তিনি দেরি করতে পারছেন না। তিনি ওই ফ্ল্যাটের ভিতর ঢোকার অনুমতি চান বাড়িওয়ালার কাছে। বাড়িওয়ালা ঘটনা শুনে দরজার তালা ভাঙেন। পুলিশ কর্মকর্তা ভিতরে ঢুকে। দুই রুমের ওই ফ্ল্যাটের চারপাশ ভালো করে দেখতে থাকেন। খেয়াল করে দেখেন, এমন কিছু মালামাল নিয়ে গেছে, যেসব জিনিস নিত্যপ্রয়োজনীয়। থালা, বাসন, পাতিল- এসব উল্লেখযোগ্য। চৌকস পুলিশ কর্মকর্তার মাথায় এ বিষয়টি খটকা লাগে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেন নেবে? কদিনের জন্য গেলে থালা-বাসন নেওয়ার কথা নয়। তাহলে কি তারা একবারেই চলে গেছে? তবে কোথায় গেছে? এমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন তার মাথায়। পাশের অপর এক ভাড়াটিয়ার ফ্ল্যাটে যান বেল্লাল। মধ্য বয়স্ক একজন মহিলার সঙ্গে তিনি গল্প জুড়ে দেন। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে তিনি কথা বলেন। কথার মধ্যেই তদন্তে সহায়ক তথ্য বের করে নেন বেল্লাল। বেল্লাল জানতে পারেন, সন্দেহভাজন ভাড়াটিয়ার নাম ঝুমা। তার স্বামী মোজাম্মেল। তারা মালামাল নিয়ে দেশের বাড়ি নেত্রকোনায় চলে গেছেন। আসতে দেরি হবে। তাদের সঙ্গে যে ট্রাঙ্ক ছিল, তা এক দিন আগে কিনেছে বলেও জানিয়ে দেন সেই মহিলা। সন্দেহ আরও তীব্র হতে থাকে বেল্লালের। বেল্লাল ভাবছে, অঙ্কের নামতার মতো সব যেন কেমন করে মিলে যাচ্ছে। কেন তারা গ্রামে গেল? বেল্লালের এমন প্রশ্নে বয়স্ক ওই মহিলা জানান, তাদের এক আত্মীয় অসুস্থ ছিল। মারা গেছে। লাশ নিয়ে যেতে হবে গ্রামের বাড়ি। আর যেন দেরি করতে পারছেন না পুলিশের কর্মকর্তা বেল্লাল। তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এবার নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে ছুটতে শুরু করল পুলিশের দল। তারা প্রথমেই গেল ঝুমাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। ঝুমাদের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায় ঢাকা থেকে নিয়ে আসা সেই আলমারি আর শোকেস। কিন্তু ট্রাঙ্ক নেই। পুলিশের সন্দেহ যেন সঠিক দিকেই যাচ্ছে। ঝুমা নেই বাড়িতে। পাশের গ্রামে এবার ঝুমার স্বামী মোজাম্মেলের বাড়িতে অভিযান। সেখানেও তারা নেই। মোজাম্মেলদের বাড়ির পেছনের ধানখেতেই পাওয়া যায় সেই ট্রাঙ্ক। যাতে ছিল পচা-গলা লাশ।

এবার খুনি ধরার পালা। পুলিশ খবর পায় ঝুমা আর তার স্বামী মোজাম্মেল আছে সিলেটে। পুলিশ খবর পেয়ে সিলেটে যায়। একে একে পাঁচটি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিং করে জানতে পারে, ঝুমা সিলেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার পথ নারায়ণগঞ্জের দিকে। পুলিশ পরদিন ভোরে সিলেটের একটি হোটেলে অভিযান চালিয়ে মোজাম্মেলকে গ্রেফতার করে। তাকে নিয়েই নারায়ণগঞ্জ। গ্রেফতার হয় ঝুমা। তাদের তথ্যে ঢাকা থেকে গ্রেফতার হয় ঝুমার ভাই জাকিরুল। এর পরের গল্প মানুষরূপী হায়েনাদের। এই তিনজনই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তারা এখন আছে কারাগারে। প্রবাসী রুবেলের কাছ থেকে নগদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নিতেই তারা হত্যা করে। ঝুমার সম্পর্কে চাচা হন রুবেল। পুলিশের জেরার মুখে ঝুমা জানায়, ‘চাচা খাটে শুইয়া ছিল, আমি ফ্লোরে বইসা আদা-রসুন বাটতেছিলাম। কোনো কিছু চিন্তা না কইরা হাতের পুঁতা দিয়া ওনার মাথায় বারি মারি। বুঝতে পারি নাই মইরা যাইব। অনেক রক্ত দেইখ্যা পরথম ঘাবরাইয়া গেছিলাম। পরে ঠান্ডা মাথায় বাজার থেইক্কা ২৫০০ টাকা দিয়া একটা ট্রাঙ্ক কিন্যা আনি। লাশটারে পরথম পলিথিনে প্যাঁচাইয়া ট্রাঙ্কে ভরতে চাইছিলাম। কিন্তু লম্বা শরীরডা ট্রাঙ্কে না ঢোকায় বঁটি দিয়া হাত-পা-মাথা টুকরা টুকরা কইরা কাটি। এরপর পলিথিনে প্যাঁচাইয়া ট্রাঙ্কে লাশ ঢুকাইয়া বইস্যা থাকি। বিছানার কাপড় দিয়া রক্ত মুইচ্ছা হেইডা আর আমার জামা-কাপড় ওই ট্রাঙ্কেই রাহি। রাইত সাড়ে ৮টার দিকে হেয় (স্বামী মোজাম্মেল হক) আইলে পুরা কাহিনি খুইল্লা কই। চাচার লগে থাকা টাকা, সোনা হেয় নেয়। লাশসহ সারা রাইত আমরা বইস্যা থাকি। পরের দিন একটা পিকআপে কইরা লাশভর্তি ট্রাঙ্কডারে আমরা নেত্রকোনা লইয়া যাই। হেইখানে নিয়া খেতে পুঁইত্তা ফেলি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর