বৃহস্পতিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

জাপার মহাসচিব নিয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

পাটোয়ারীকে জি এম কাদের, মসিহকে রওশন, হাওলাদারকে চান শীর্ষস্থানীয় নেতারা

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুর দুই দিন পর থেকেই নতুন মহাসচিব নিয়োগ নিয়ে পার্টিতে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। পার্টির চেয়ারম্যান  গোলাম মোহাম্মদ কাদের গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব নিয়োগ দিচ্ছেন এমন খবর সোমবার ছড়িয়ে পড়ে। এতে পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফিরোজ রশীদের ধানমন্ডির সুলতানা টাওয়ারে ওই দিন বিকালে জরুরি বৈঠক করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, জাতীয় পার্টির মতো একটি বৃহৎ দলে ৪১ বছরের তরুণ শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব হিসেবে মেনে নেওয়া হবে না। পার্টিতে ত্যাগী সিনিয়রদের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নিয়োগ দিতে হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, পার্টির সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব করার বিষয়ে তারা একমত পোষণ করেন। রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব না করা হলে পার্টির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা কিংবা কো-চেয়ারম্যানদের থেকে যে কোনো একজনকে মহাসচিব করার পক্ষে মত দেন তারা।

একাধিক সূত্র জানায়, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ চান পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম মসিহকে মহাসচিব করা হোক। আর পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের চান তরুণ শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব করতে। এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসায় পার্টির চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা থাকলেও তিনি মহাসচিব নিয়োগ দেননি। আগামী ৮ অক্টোবর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর স্মরণসভা শেষে মহাসচিব নিয়োগ করা হবে। এদিকে আগামী জানুয়ারিতে পার্টির সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। এ সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, লিয়াকত হোসেন খোকা ও রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার নাম আলোচনায় রয়েছে।

জাপা সূত্র জানায়, শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার চিঠিতে সোমবার দুপুরে স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। সংবাদটি পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা জানতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে ফুঁসে ওঠেন। বিকালে ফিরোজ রশীদের কলাবাগানের সুলতানা টাওয়ারে বৈঠকে বসেন তারা। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল আলম রুবেল। তারা বলেন, রাজপথের আন্দোলনে শামীম হায়দার পাটোয়ারীর অবদান নেই। দলের সুদিনে এসে এমপি হয়েছেন। জাতীয় পার্টিতে অনেক ত্যাগী ও সিনিয়র নেতা রয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলে তার মতো একটি বাচ্চা ছেলে কখনই মহাসচিব হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। এ বৈঠকে শামীম হায়দারকে মহাসচিব না বানানোর বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেন। বৈঠক থেকে মুজিবুল হক চুন্নু টেলিফোনে জি এম কাদেরকে বলেন, সারা দেশের নেতা-কর্মীদের কেউ অল্প কদিন আগে দলে আসা কাউকে মহাসচিব পদে মানবেন না। তিনি যদি জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে কাউকে মহাসচিব নিয়োগ করেন, তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য চেয়ারম্যান হিসেবে তাকেই দায়ী থাকতে হবে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পাটোয়ারীর মতো একটি বাচ্চা ছেলেকে মহাসচিব মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। পার্টির কোনো নেতা-কর্মীরাও তা মেনে নেবেন না। তৃণমূলের কর্মীরাও চান হেভিওয়েট কেউ পার্টির মহাসচিব হোক।’ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘কো-চেয়ারম্যান থেকে যে-কাউকে মহাসচিব বানাতে হবে। তাহলে আমাদের কারও আপত্তি থাকবে না। কারণ এ পদটি হেভিওয়েট একটি পদ।’

মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘শামীম পাটোয়ারীকে মহাসচিব করা হলে রংপুরের কোনো নেতা-কর্মী তা মেনে নেবেন না। বৃহত্তর রংপুরে তাকে অবাঞ্ছিত করা হবে এবং তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে। তাকে প্রতিহত করা হবে। জুনিয়র একটি ছেলেকে আমাদের মাথার ওপর বসিয়ে দেবে তা হবে না।’

নেতা-কর্মীরা বলছেন, জাতীয় পার্টিতে মহাসচিব পদপ্রত্যাশী অনেক সিনিয়র নেতা শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে জুনিয়র আখ্যা দিয়ে তাকে মহাসচিব পদে মানতে নারাজ। মহাসচিব পদ নিয়ে যদি সুষ্ঠু কোনো সমাধানে না আসা যায়, তাহলে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সম্মেলন পর্যন্ত চালানো সম্ভব। এ ছাড়া মহাসচিব পদের জন্য আলোচনায় রয়েছেন পার্টির কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ।

জানতে চাইলে পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, ‘পাটোয়ারীর মতো একটি বাচ্চা ছেলে, তাকে আমাদের মহাসচিব মানতে হবে? জুনিয়র লেভেল থেকে মহাসচিব করা হলে পার্টিতে যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে তাদের কী হবে? আমরা চাই গ্রহণযোগ্য যে কোনো সিনিয়র নেতা পার্টির মহাসচিব হোক।’

সিলেট বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব এ টি ইউ তাজ রহমান অবশ্য বলেন ভিন্ন কথা, ‘কাউন্সিলে পার্টির চেয়ারম্যানকে মহাসচিব নিয়োগের একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি বিজ্ঞ লোক। সবকিছু বিবেচনা করেই মহাসচিব নিয়োগ দেবেন। তার নির্দেশনা মেনেই আমরা পার্টিকে এগিয়ে নেব।’

সামগ্রিক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাউন্সিলের মাধ্যমে পার্টির চেয়ারম্যানকে এককভাবে মহাসচিব নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মহাসচিব নিয়োগকে কেন্দ্র করে পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বৈঠক করতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে আমাকে অফিশিয়ালি কিছুই জানানো হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কাজ করলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ প্রয়োজনে দল থেকে বের করে দেওয়া যেতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর