রবিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

জেগে উঠছে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

সবখানেই বেড়েছে কাজের ব্যস্ততা । বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি । রাজস্ব আয়েও ইতিবাচক ধারা । মানুষের নতুন ভোগান্তি অস্বাভাবিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি

মানিক মুনতাসির

জেগে উঠছে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নেমে এসেছে ৩ শতাংশের নিচে। জীবন সংহারের ভয়ভীতি কেটে গেছে আরও আগেই। ভ্যাকসিন কার্যক্রমও চলছে বেশ জোরেশোরে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গণহারে টিকা নিচ্ছে মানুষ। ব্যাংক, বাস টার্মিনাল, শিল্পকারখানা, ফুটপাথ, শপিং মল, ছোটখাটো শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন বাড়ছে উৎপাদন, পণ্য ডেলিভারি ও কেনাবেচা। বন্দরে গতি বেড়েছে পণ্য খালাস ও জাহাজ বোঝাইয়ের ক্ষেত্রেও। বিদেশযাত্রা ও দেশে ফেরার ক্ষেত্রেও বিমানবন্দরে ফিরেছে স্বাভাবিক গতি। ২৪ ঘণ্টায় আগমন ও বহির্গমনে শতাধিক ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় দেড় বছর পর আবারও জেগে উঠছে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি।

যার ফলে সবখানেই বেড়েছে কাজের ব্যস্ততা। বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি। রাজস্ব আয়েও ফিরেছে ইতিবাচক ধারা। প্রাণ ফিরেছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে। যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা ছেদ পড়েছে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন খুব তাড়াতাড়িই আবারও স্বাভাবিক গতি ফিরবে রেমিট্যান্সে। তবে মানুষকে নতুন করে ভোগান্তিতে ফেলেছে অস্বাভাবিক হারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস, সবজির দাম এমনভাবে বেড়েছে, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মেলাতে রীতিমতো ভিরমি খেতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। দিনমজুর, শ্রমজীবী মানুষ নির্বিঘ্নে কাজে যেতে পারছেন। ক্ষুদ্র ও ফুটপাথের ব্যবসায়ীরাও আবার দোকানে শীতের পোশাক তুলতে শুরু করেছেন। শপিং মলে ক্রেতাসমাগম বেড়েছে। ঘরে ও ঘরের বাইরে নির্বিঘ্নে কাজ করছে মানুষ। ফলে মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ অচলাবস্থার পর কলকারখানাসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডস্থল খুলে দেওয়ায় আবারও গতি ফিরছে দেশের অর্থনীতিতে।

কেস স্টাডি : চান মিয়া। পেশায় রিকশাচালক। পরিবার-পরিজন নিয়ে এক বছর আগে ঢাকা ছেড়েছিলেন। দুই সপ্তাহ হলো আবার ঢাকায় ফিরেছেন। আগের মালিকের কাছ থেকেই রিকশা নিয়েছেন ভাড়ায় চালাতে। অবশ্য এ দফায় তিনি স্ত্রী-সন্তানদের আনতে পারেননি। তাই মনে কিছুটা কষ্ট আছে। দুই মেয়েকে নীলফামারীতে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ বাদে ৮০০-১০০০ টাকা আয় করছেন। এটা প্রায় দুই বছর আগের অবস্থার মতোই। তবে  রিকশা গ্যারেজে এখন তার খাওয়ার খরচ কিছুটা বেড়েছে। কেননা চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংসসহ সবকিছুর দাম বাড়তি। চান মিয়া জানান, এখন আর করোনাভাইরাসের ভীতি কাজ করে না। মাস্ক ইচ্ছা হলে পরেন না হলে পরেন না। তবে হাত না ধুয়ে কিছু খান না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক আবুল কাসেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘ বিরতির পর দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুরোদমে শুরু হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানগুলো আবারও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মানুষ কাজ করছে। তবে মানুষের মনে অজানা একটা আতঙ্ক তো রয়েছেই। যদিও তা আগের তুলনায় অনেকটা কম। আর শিল্প খাতের উৎপাদন শুরু হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিও বাড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে তো মনে হচ্ছে করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেননা দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে কভিড-১৯ মহামারী সত্ত্বেও দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২০২৪ মার্কিন ডলার। অবশ্য চূড়ান্ত হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা সাময়িক হিসাবে ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর ফলে গণহারে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি সফল হলে সামনের দিনগুলোয় দেশের অর্থনীতি আবারও আগের অবস্থানে ফিরে যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার হিড়িক পড়েছে। এ ছাড়া পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি দুটিই বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের রাজস্বও বেড়েছে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আগস্টে আমদানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৩ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। একইভাবে আগস্টে সরকারের রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশের বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা দীর্ঘদিনের স্থবিরতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সে কারণেই একদিকে রপ্তানি আয় বাড়ছে, অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানি বেড়েছে। বাড়ছে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত আগস্টে ৬০৯ কোটি ১০ লাখ (৬.০৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। গত বছরের আগস্টে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৩৫২ কোটি ১০ লাখ (৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন) ডলারের। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে আমদানি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। শুধু আমদানি নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রেও এমন ইতিবাচক ধারা ফিরেছে। সেপ্টেম্বরে সার্বিকভাবে ৪১৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। গত বছর সেপ্টেম্বরে সার্বিকভাবে ৩০১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এদিকে অথনৈতিক কর্মকান্ডে চাঞ্চল্য ফেরায় বেড়েছে সরকারের রাজস্বও। ফলে অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে সরকারের রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আগের মাস জুলাইয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছিল ৪ শতাংশ। এতে এক মাসের ব্যবধানে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২০ শতাংশ। বিশ্লেষকরা একে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এটা অবশ্যই ইতিবাচক যে করোনার সংক্রমণ কমে আসায় মানুষ কাজে ফিরেছে। শিল্পকারখানা আবারও সচল হচ্ছে। ফলে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি ফিরেছে। তবে একটা জায়গায় সংকট রয়েই গেছে, তা হলো বহু মানুষ এখনো কর্মহীন। আর যারা কাজের মধ্যে আছেন তাদেরও আয় কমে গেছে। আবার পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আমরা যাদের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত হিসেবে ধরতাম তারা এখন প্রায় হারিয়েই গেছেন।’ এখানে সরকারের অনেক কিছু করার আছে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর