শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

আগুন আতঙ্ক হাসপাতালে

রাজধানীসহ বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে দুর্ঘটনা, সতর্কতার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

জিন্নাতুন নূর

আগুন আতঙ্ক হাসপাতালে

দেশের হাসপাতালগুলো আগুনের ঝুঁকি নিয়েই রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আর করোনাকালে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই তিনটি বড় অগ্নিকান্ডে রোগীর প্রাণহানি ঘটেছে। মূলত হাসপাতালগুলোয় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকলেও এর বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় আগুন লাগার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে অগ্নিনির্বাপণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা; অন্যদিকে মহামারী চলাকালে হাসপাতালগুলোর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) বেশি অক্সিজেনের ব্যবহার হওয়ায় অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় হাসপাতালগুলোয় একপ্রকার আগুন আতঙ্কের মধ্যেই সেবা নিচ্ছেন রোগী ও স্বজনরা। ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে দেখা যায় অগ্নিঝুঁকি কমাতে যে ধরনের সরঞ্জাম থাকার কথা তা সেখানে নেই। আবার আগুন নেভাতে যে পরিমাণ পানি জমা থাকার কথা তা-ও হাসপাতালে থাকে না। ফায়ার পাম্পগুলোও শনাক্ত করা নিয়ে ঝামেলা আছে। এসব  দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছয় তলায় আইসিইউ ও ক্যাথ ল্যাবে ২১ অক্টোবর আগুন লাগে। এ ঘটনায় ১০ জন দগ্ধ হন। হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, ছয় তলায় অবস্থিত ইকো ক্যাথ ল্যাবে এসির বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত। চলতি বছরের ১৭ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কভিড ওয়ার্ডের আইসিইউতে আগুনে তিন রোগীর মৃত্যু হয়। হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় আগুনের সূত্রপাত। আগুন লাগার পর আইসিইউ ওয়ার্ড থেকে ১৪ রোগীকে অন্য আইসিইউতে স্থানান্তর করা হলে পরে তাদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ওয়ার্ডের সব আইসিইউ মেশিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধারণা করা হয়, বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে কোনো একটি আইসিইউ মেশিন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এর আগে ২০২০ সালের মে মাসে রাজধানীর বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আগুনে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। সে বছরের ২৭ মে হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে (মূল ভবনের বাইরে স্থাপিত) আগুন লাগে। পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, আইসোলেশন ওয়ার্ডের ভিতর দুটি কক্ষ ছিল। এর মধ্যে চিকিৎসক ও নার্সদের যে কক্ষ সেখানকার এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সে সময় সাংবাদিকদের জানান, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে হাসপাতালে আগুন লাগে। তিনি আরও জানান, দেশের বেশ কিছু হাসপাতাল পুরনো। এগুলোর অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের এক পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত বছর সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে মোট ৯০টি অগ্নিকান্ড ঘটে। ২০১৭ সালে এ সংস্থাটি দুই দফায় রাজধানীর ৪৩৩টি হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে ৪২২টিই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানায়। এর মধ্যে অতিঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় আছে ১৭৩টি। সাধারণ ঝুঁকিতে আছে ২৪৯টি। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ আরও প্রায় ২০টি হাসপাতাল এই অতিঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে। পরিদর্শনে মাত্র ১১টি হাসপাতালকে সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অগ্নিনির্বাপণ কাজে সিঁড়ির ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্থানসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অনেক নামিদামি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। তবে হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে করোনাকালে রোগীর অতিরিক্ত চাপ থাকার কারণেও অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন। এ ছাড়া জেলা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রাজধানীর বাইরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর অবস্থা খুব শোচনীয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অবস্থা জরাজীর্ণ। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালগুলোকে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নিয়ে কয়েক দফা নোটিস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ হাসপাতালই বিষয়টি আমলে নেয়নি। যদি তারা দ্রুত ব্যবস্থা না নেয় তবে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে আমাদের বেশির ভাগ হাসপাতালকে হাসপাতাল হিসেবে তৈরি করা হয়নি। অগ্নি প্রতিরোধে যেসব সুবিধা থাকার কথা অনেক হাসপাতালেই তার ঘাটতি আছে। দেশের অনেক ভবন আছে যেগুলো বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে তৈরি হয়নি। এটা বলা যেতেই পারে যে বেশ কিছু হাসপাতালে অগ্নিঝুঁকির সমস্যা রয়ে গেছে। ভবিষ্যতে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে যত দ্রুত সম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালগুলোয় সন্তোষজনক অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’ মহামারীতে হাসপাতালগুলোয় অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও সাজ্জাদ হোসাইন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘করোনা রোগীর জন্য বেশি পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এর ফলে হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর পাশাপাশি অক্সিজেনও বেশি ব্যবহৃত হয়। এতে যে পরিমাণ অক্সিজেন পাম্প করা হয় তার সব রোগী নিতে পারে না। ফলে কিছু অক্সিজেন বাইরে চলে আসে। আর আইসিইউতে এভাবে অক্সিজেন চলে আসায় আগুন লাগার ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে রাখতে হবে, অগ্নিদুর্ঘটনা সৃষ্টিতে অক্সিজেন মুখ্য ভূমিকা রাখে। আবার সাধারণ সময়ের চেয়ে করোনাকালে ২০-২৫ গুণ বেশি আইসিইউ ব্যবহার হওয়ায় হাসপাতালগুলোয় অগ্নিঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর